Advertisement
Durga Puja 2020

বর্গী হামলায় বন্ধ হয়নি কালনার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো

রীতি মেনে শুরু হয় পুজো। তারপর হঠাৎ একদিন পুজোর রাতেই ঘটে বর্গী আক্রমণ।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০ ০৭:০০
Share: Save:

তখন বর্গী হানায় জেরবার বাংলা। প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে অনেকেই বাড়িঘর, ধন-সম্পত্তি, ছেড়ে সপরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পা বাড়িয়েছেন। সময়টা ছিল শরৎ কাল। সে বার বর্গী হামলার আশঙ্কায় বর্ধমান জেলার কাটোয়ার সকলেই আতঙ্কে সন্ত্রস্ত। তবু অটুট ভক্তি ও আস্থা সম্বল করেই পারিবারিক দুর্গোৎসব বন্ধ না রাখার সিদ্ধান্ত নিল কালনার নৃপপল্লির চট্টোপাধ্যায় পরিবার।

রীতি মেনে শুরু হয় পুজো। তারপর হঠাৎ একদিন পুজোর রাতেই ঘটে বর্গী আক্রমণ। বাড়ির মহিলারা তখন কালো হাঁড়ি মাথায় নিয়ে বাড়ির পাশে পুকুরে লুকিয়েছিলেন। পুরুষরা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন আশপাশে কোথাও। তবু দৈব কৃপায় কারও প্রাণহানি বা পুজোয় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নির্বিঘ্নেই মিটেছিল সে বারের পুজো।

তারপর ভাগীরথী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল।আজকের জনবহুল, ঘিঞ্জি কালনা শহরকে দেখে অতীতের সে সব ঘটনা গল্পকথা মনে হতেই পারে। তবু এ শহরের আনাচকানাচে পুরনো ইটের পাঁজরে মিশে আছে এমন কত না অজানা কাহিনি। তেমনই এখানকার পুজোয় মিশে আছে কত স্মৃতি এবং জনশ্রুতি।

আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের নেকনজরে সিদ্ধিলাভ, দুর্গাপুজো শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়িতে

পরিবারে প্রচলিত প্রথা অনুসারে পুজো করেন বাড়ির সদস্যরাই।

এ বাড়ির পুজো ঠিক কোন সময় শুরু হয়েছিল, বা কে শুরু করেছিলেন তা সঠিক জানা না গেলেও পুজোটি বর্তমানে চরণদাস চট্টোপাধ্যায়ের পুজো বলে পরিচিত। পরিবারের এক সদস্য ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, পুজোটি চরণদাস চট্টোপাধ্যায়ের মামা নগেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো। নগেন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নিঃসন্তান।এ দিকে চরণদাস চট্টোপাধ্যায়ের বাবা-মা তাঁর বাল্যকালেই প্রয়াত হয়েছিলেন। তাই মামাই তাঁকে লালনপালন করে বড় করে তোলেন। মামারবাড়ি সূত্রে পাওয়া পুজোটি চরণদাস চট্টোপাধ্যায় বজায় রেখেছিলেন। অন্য একটি মতে আবার মনে করা হয়, মাখন চট্টোপাধ্যায়ের হাতে এই পুজো শুরু হয়েছিল।

পরবর্তী কালের একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সে সময়ে সদ্য সতীদাহ প্রথা রদ করেছে ইংরেজ সরকার। তার কল্যাণেই এই পরিবারের দুই বধূ অন্যবালা দেবী ও পুণ্যবালা দেবী সতী হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই খুশিতে পরিবারে প্রচলিত দুর্গোৎসব তাঁরা সাড়ম্বর পালন করেছিলেন।

আরও পড়ুন: ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো পদ্ধতি

পুরনো রীতি মেনে জন্মাষ্টমীতে হয় কাঠামোপুজো। ডাকের সাজে সুসজ্জিত সাবেক বাংলা রীতির প্রতিমাকে পরানো হয় সোনা-রুপোর গয়না। দেবীর বাহন এখানে পৌরাণিক সিংহ। প্রতিপদ থেকে নবমী হয় চণ্ডীপাঠ।

ডাকের সাজে সুসজ্জিত সাবেক বাংলা রীতির প্রতিমাকে পরানো হয় সোনা-রুপোর গয়না।

এই বাড়ির পুজোয় রয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী আচার আনুষ্ঠান। কালিকাপুরাণ মতে অনুষ্ঠিত পুজোর ক’দিন ভোর চারটে নাগাদ হয় মঙ্গল-আরতি। এর পরে হয় বাল্যভোগ, তাতে থাকে নাড়ু, মাখন-মিছরি। তার পরে হয় মূল পুজো। রকমারি ফলের সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের পানীয়। যেমন লেবুজল, কর্পূরজল, চিনিজল, ডাবেরজল ও গঙ্গাজল। এই বাড়ির পুজোয় বাড়িতে তৈরি নানা ধরনের নারকেলের মিষ্টি দেওয়া হয়- চিনি ও গুড়ের নাড়ু, নারকেল ছাপা ইত্যাদি। পুজোয় অন্নভোগে থাকে সাদাভাত, শুক্তো, ন’রকম ভাজা, কুমড়ো দিয়ে পুরের ভাজা, খিচুড়ি, ভাজা, চচ্চড়ি, পুষ্পান্ন, কালিয়া, ডালনা, চাটনি, পায়েস। নবমীতে এর সঙ্গে যোগ হয় মাছের ঝোল, টক ও ঝাল এবং পুঁইশাকের চচ্চড়ি। সবই মাটির হাঁড়িতে রান্না করা হয়। বিকেলে বৈকালিক বা জলপানিতে থাকে ফল ও মিষ্টি এবং রাতের শীতল ভোগে থাকে লুচি, দুধ, মিষ্টি।

আরও পড়ুন: মেয়ের কথা রাখতেই শুরু হয়েছিল সোনার দুর্গাবাড়ির পুজো

আগে পুজোয় মোষ ও পাঁঠা বলি হলেও বর্তমানে চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোয় এ বাড়িতে অন্নভোগ হয় না। থাকে লুচি, আটভাজা, চিড়ে-মুড়কি। দশমীর দিনে দেওয়া বাসি লুচি। থাকে সিদ্ধির নৈবেদ্য। এ দিন পরিবারের সদস্যরা বেলপাতায় শ্রীশ্রীদুর্গাসহায় লিখে দেবীর পায়ে নিবেদন করেন।

পরিবারে প্রচলিত প্রথা অনুসারে পুজো করেন বাড়ির সদস্যরাই। তেমনই পুজোর সব কাজ করেন বাড়ির সকলে হাতে হাত মিলিয়ে।এই বাড়ির এক বিশেষ প্রথা অনুযায়ী বিজয়া দশমীর দিনে বিসর্জনের আচারে সুতো কাটার সময়ে শিবের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয় চিঠি। পুরনো রীতি মেনে বারোজন কাহার কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে যান। আজও ব্যবহার করা হয় কার্বাইড গ্যাসের আলো। ঐতিহ্যবাহী এই পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখতে ভিড় করেন বহু দর্শনার্থী।

ছবি: পরিবার সূত্রে পাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE