শ্রীজাত
ছোটবেলার পুজো, কথাটার কোনও বিকল্প নেই। কেননা, আজ মনে হয়, আমার বা আমাদের কারও কারও পুজো যেন সেই ছোটবেলাতেই আটকে আছে। সেখান থেকে খুব বেশিদূর সে এগিয়ে আসতে পারেনি। বা বলা ভাল, চায়ওনি।
এখন পুজো কেমন কাটে, সে কথায় যাচ্ছি না। ইদানীং কালের সমস্তটাই খারাপ, এমন যাঁরা মনে করেন, আমি তাঁদের দলে এখনও নাম লেখাইনি। তাই এখনকার পুজোতেই নিজেদের মতো একটুখানি সময় কাটিয়ে নিই। তবে হ্যাঁ, ছোটবেলার পুজোর সঙ্গে তার তুলনা করব, এমন মিথ্যুকও আমি নই।
ছোটবেলার পুজো নিয়ে বলতে গেলে সে চলতেই থাকবে, থামবে না। এত রকমের, এত ধরনের অনুসঙ্গ তাতে জড়িয়ে ছিল যে, পুজো মানেই স্মৃতিদের লম্বা তালিকা। সেই তালিকার সব নামে দাগ না দিয়ে বরং পুজোয় নতুন বই আর গানের কথাটুকুই মনে করি, যা এখন সবচাইতে বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন:দেশের বাড়ির পুজোয় গেলে ভোরের তারাই সাঁঝের তারা হয়ে ফিরে আসে: বিনায়ক
মনে আছে, পুজোর আগে থাকতে মুখিয়ে থাকতাম, কবে পূজাবার্ষিকী বেরবে। বড়দেরগুলো নয় মোটেই, ও সব বাবা মায়েরা পড়েন। আমার নজর থাকত, স্বভাবতই, কিশোর আর খুদেদের জন্য বেরনো পূজাবার্ষিকীতে। বাবা কাজ করতেন খবরের কাগজে, একটু কম দামে কিনতে পারতেন সে সব সংখ্যা। আমার দাবি থাকত, পুজোয় জামা হোক আর না হোক, পূজাবার্ষিকীরা যে দিন যে দিন বেরবে, সে দিন সে দিন যেন তারা বাবার কাঁধঝোলায় চেপে বাড়ি ঢোকে।
সে দাবি যে পূরণ হত সব সময়ে, এমন নয়। বেরনোর বেশ কয়েক দিন পরেও বাড়িতে আসত সে সব মোটা মোটা রংচঙে, চকচকে, সুগন্ধী সঙ্কলন। কিন্তু সেইখানেই শুরু হত সমস্যা। তত দিনে জেনে গেছি কোন সংখ্যায় কে কে লিখছেন, কী তাঁদের গল্প বা উপন্যাসের নাম এবং সে নিয়ে রোমাঞ্চও যাকে বলে একেবারে তুঙ্গে, কিন্তু না। ফাঁকা গোল পেয়েও অনেক সময়ে যেমন বল বার-এ লেগে ফিরে আসে, তেমনই হাতে লেগে আবার বাবার ঝোলাতেই ফিরে যেত সে সব পুজোসংখ্যা। কারণ আর কিছুই নয়, তখন নিশ্চিত ভাবে স্কুলের কোনও না কোনও বিচ্ছিরি পরীক্ষা চলত। এবং আমার বাবা মা জানতেন, ছেলে সারা বছর বই দেখতে অবধি পায় না। অন্তত পরীক্ষার দিন ক’টা যদি একটু পড়ার বই না খোলে, একে পাশ করায় কার সাধ্যি। অতএব, এক বার স্পর্শ করে, চক্ষু সার্থক করে, ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে চকচকে পাতার ভাঁজে একটি বার ডুবিয়ে তুলে নেওয়া। ব্যস। তার পরেই সে সব বই দেরাজবন্দি।
তত ক্ষণে কিন্তু মহালয়া পার হব হব ব্যাপার, বা হয়তো হয়েও গেছে। পাড়ার মোড়ের প্যান্ডেল সেজে উঠেছে ঝালরে, সন্ধের পরপর বেরলে খুব সামান্য একটা শিরশিরানি টের পাওয়া যাচ্ছে হাওয়ায়, মাঝেমধ্যে বক্সে বেজে উঠছে পুজোর সব নতুন গান। এ দিকে মন দিতে হচ্ছে পরীক্ষায়।
সত্যি বলতে কি, মনও বন্দি থাকত ওই দেরাজেই। আমি বরাবর রাতচরা প্রাণী। সকলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর পা টিপে টিপে দেরাজের কাছে পৌঁছতাম। ঘরের জানলা খোলা, একটা ছোট ঘুমের আলো জ্বলত তখন, নীলাভ। বাতাসে ছাতিমের গন্ধ চনমন করছে সারা ক্ষণ, আর নেশার মতো আমাকে সম্মোহনে টানছে ওই বইলুকনো দেরাজের ডালা।
আমি করতাম কি, খুউব আস্তে, যাতে শব্দ না হয়, এমন ভাবে দেরাজের ডালা খুলে হাতড়ে কোনও একটা পূজাবার্ষিকী বার করে আনতাম। তাকেই তখন মনে হত জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেম, আর সেই স্পর্শ জীবনের প্রথম প্রেমের স্পর্শের চেয়ে কম দামী নয়। অল্প আলোয় অক্ষর কিছুই পড়া যাচ্ছে না, তা-ও পাতার পর পাতা উল্টে ছবিগুলোয় হাত বোলাতাম, গল্প উপন্যাসের প্লট বোঝার চেষ্টা করতাম ওই ছবি দেখেই। একই সঙ্গে শিহরন আর বিষাদ আসত, কেননা পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই এই আলিঙ্গন ফুরোবে, এবং আমাকে শুতে যেতে হবে।
আরও পড়ুন:বদলে গেছে পুজোর রং, আমার বুকে আজ আর তোলপাড় নেই: অর্পিতা
হতও তাই। পরের দিন হয়তো অঙ্ক পরীক্ষা, প্রশ্নমালা ১৬-র বদলে স্বপ্নে এলেন কাকাবাবু বা প্রফেসর শঙ্কু। সে ভাবেই দিতাম পরীক্ষা, জানলার বাইরে টাটকা ঘন নীলের মধ্যে আটকে থাকা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চুল দেখতে দেখতে। কারা যে ওই সময়ে পরীক্ষার আমদানি করেছিলেন, কে জানে!
শেষমেশ ও সব যখন কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারতাম, পাড়ার প্যান্ডেলে এসে পড়তেন দূরদূরান্তের ঢাকিরা, আমারও হাতে উঠে আসত পুজোসংখ্যার ঝাঁক। ওই যে ডুব, তার আনন্দ বোধ হয় সমুদ্রকেও হার মানাবে। আজও বাড়িতে পুজোসংখ্যার সমাহার জারি আছে। মায়ের জন্য এক রকম, দূর্বা’র জন্য এক রকম, আবার কিছু পুজোসংখ্যায় লেখার দরুণ আপনিই চলে আসে। কিন্তু সেই শিহরন আর বিষণ্ণতা আর ফেরে না। যেমন বাবা আর ফিরবেন না কোনও দিন। ঝোলা কাঁধে। ওঁর সেই মলিন, ক্লান্ত ঝোলায় আমার ছোটবেলার পুজোটা ছিল। সেও ফিরবে না আর।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy