প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

মায়ের কোলে শুয়ে মহালয়া শুনতে শুনতে ঘুম নামে চোখে: তিলোত্তমা

জীবন যত এগিয়েছে, পূজার দিনগুলি বিচ্ছেদ ও বেদনার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন।

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:৫৬

দুর্গাপূজা যত ক্ষণ আনন্দোৎসব, আমার সকল অনুভূতি মিশিয়ে আছে ছোটবেলায়। বোধের উন্মেষ যখন শৈশবে শরতের ভোরের মতো, সেই থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধি, যখন বন্ধুত্বের ভিতর এক অধীর অংশে শরতের আকাশের মতো অনুরাগ নীলিমা, বুকের ভিতর বিচ্ছুরিত অস্তরাগের রং। এরপর জীবন যত এগিয়েছে, পূজার দিনগুলি বিচ্ছেদ ও বেদনার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন। এ এক রকম দুর্ভাগ্য বলা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য নিয়ে বিষাদাক্রান্ত হওয়ার চেয়ে আমার বরাবরের পছন্দ ছোটবেলার সুখের শিউলি আর আনন্দের রঙিন পদ্মগন্ধী মুহূর্তসমূহ দিয়ে দুর্ভাগা ভস্মপাত্র একেবারে আড়ালে করে ফেলা!

আমি যে আমি, তার জ্ঞানের আদিপর্বে আমার মনে পড়ে মহালয়ার ভোর। আলো না ফোটা ভোর। যখন আকাশে প্রগাঢ় অন্ধকারে নীল রং লাগে, তার উপর মিটমিটে তারা বহ্নিমান। গভীর ঘুমের ভিতর মায়ের ডাক ভেসে আসে— ওঠ, মহালয়া শুনবি না?

জোর করে চোখ মেলে দেখি, কম্বলে দাদা ও দিদি-সহ নিজেকে মুড়ে জানলার পাশে বসে আছে বাবা। হাসছে। ওরাও হাসছে। মহালয়া মানেই পূজা। আমিও কম্বল মুড়ি দেব। মার কোলে শুয়ে শুনব দুর্গাবন্দনা। আমি একটু গোমড়ামুখো। কারণ, কোনও অজ্ঞাত কারণে, পূজার এই সময়টায় আমার জ্বর হয়, কিংবা রক্তচাপ নেমে যায়, কিংবা অদ্ভুত অসুখে আমার সারা গায়ে জলফোস্কা পড়ে। তাই আমি আর মা বাড়িতে আটকা পড়ে যাই। পূজার বাজার করতে যেতে পারি না। দাদা আর দিদি বাবার সঙ্গে হাসতে হাসতে যায়। বাবা মাটিতে সাদা কাগজ পেতে আমার আর মা’র পায়ের ছাপ নিয়ে নেয়। জুতো আসবে। বাটা ছাড়া অন্য কোম্পানির জুতো কিনবেই না বাবা। আর মা’র শাড়ি আসে তন্তুজ থেকে। হয় সিল্ক, নয় তাঁত, বাবা কখনও ডেক্রন, জর্জেট, টেরিকট কেনে না। সেই না-কেনার গভীর ধারা সংস্কারের মূল চাড়িয়ে দিল কবে অন্তরে। আজও আমার পোশাকে বাটার জুতো, রেশমি ও সুতি বস্ত্র। অন্য কিছু পরলেই গায়ে জ্বালা করে, ত্বকে ফুটে ওঠে অন্তর্লীন প্রতিবাদ।

আমাদের নিজস্ব রেডিয়ো ছিল না তো অনেক দিন। পাশে অনিলজেঠুর বাড়িতে রেডিয়ো, সেইখানে মহালয়া। ওরাও জানে আমরা শুনছি, তাই জোরে দেয়। ‘শঙ্খে দিলেন ফুৎকার’ শুনে দাদা-দিদি হেসে গড়িয়ে পড়ল। ফুৎকার ফুৎকার ফুৎ ফুৎ ফুৎ! আমারও হাসি পাচ্ছে। ফুৎকার— যেন দন্তহীন বুড়োর মুখে উৎখাত হওয়া শব্দ। আমার দাদুর তো দাঁত নেই। মানে ঠাকুরদাদার। শুধু লাল মাড়ি। তবু হাসা চাই। দাঁত না থাকলে হাসতে হয়? আমি রাগে দাঁত কিড়মিড় করি। তার উপর ফুৎকারের উৎপাত। আমি হাসি চেপে মার কোলে আরও খানিক সেঁধিয়ে যাই। মা কপালে হাত দিয়ে দেখল গরম কিনা। শাঁখাটা যে কপাল ঠুকে দেয়, বোঝে না! নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ শুনতে শুনতে আমার চোখে ঘুম নেমে এল। প্রতি বার একই রকম। কখন ভোরের আলো ফুটল, মাতল রে ভুবন, বাজল তোমার আলোর বেণু গানও হল, কিচ্ছুটি টের পাইনি। বাবা ডাকছে, ওঠো, ক্লাবমাঠে যাবে না? ওঃ! ক্লাবমাঠ! সে এক দারুণ জায়গা। এত সুন্দর মাঠ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। দাদা-দিদি তখনও হাসছে, কীসের এত হাসি ওরাই জানে। আমি গম্ভীর মুখে বাবার কোলে। ওদের গায়ে গরম পোশাক। কেননা ডুয়ার্সে পূজার আগেই ভোরের বেলায় শিশিরসিক্ত শীতলতা। কখনও দু’-এক পশলা বৃষ্টি ঠান্ডা বৃদ্ধি করে। বাবা বিশাল এক চাদরে নিজের সঙ্গে আমাকেও মুড়ে নিল। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় আমরা চললাম। মা নয়। মা তো দাদুর সেবাযত্ন করবে। আমাদের সকালের খাবার বানাবে। শিউলি গাছ ঝাঁকিয়ে অজস্র ফুল ফেলে রাখবে উঠোনে যাতে আমরা কুড়িয়ে তুলি!

দাদা-দিদি দৌড়চ্ছে। বিশাল মাঠের শেষ নেই। আমার তো জ্বর। বাবা কোল থেকে নামাবেই না। বরং একলা হয়ে একটু গান গেয়ে নিচ্ছে। বেসুরো। তাতে কী! আমি শুনতে শুনতে ভাববিহ্বল গাল রাখি বাবার গালে। দাড়ির খরতা গালে ব্যথা দেয়। সেই ব্যথা ভারী আরামের। আমি ঘুমিয়ে পড়ি ফের।

ক্লাবমাঠ থেকে গন্তব্য মণ্ডপ। লাল রং করা বিশাল পাকা মণ্ডপ আমাদের। সেখানে কালচিনির প্রতিমা গড়ে ওঠেন। অন্যদের মতো আমাদের বড়রা হ্যামিল্টনগঞ্জের কুমোরপাড়া থেকে তৈরি ঠাকুর কিনে আনে না। আমাদের কুমোর পালমশাই আসেন। মহালয়ার দিন মূর্তি তখনও অসম্পূর্ণ। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় ঠাকুর আমাদের। এই নিয়ে ভারী গর্ব! আমরা সবাই আমাদের নিজ নিজ মাতৃমুখ ওই প্রতিমায় দেখতে পাই! বিমলদা ঢাকির চুল তো অবিকল অসুরের মতো। যেন মায়ের পদতল থেকে উঠে এসে ঢাক বাজাচ্ছে! কী অসামান্য বাজনা! তালে তালে ধুনুচি নেড়ে আমি দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেলাম। প্রথম মামণি আর রুপু। তৃতীয় মনা আর মুন।

অথচ মহালয়া থেকে পূজা পর্যন্ত এক উদ্বেগ-উদ্বেল প্রত্যাশা ভোরের হিমেল বাতাসে মিশে থাকে। সূর্যাস্তে আকাশে মেঘের দলে লাল-কমলা আলোর ছটায় ঝুলে থাকে একটুকু কালো মেঘের মতো। বোনাস কবে হবে? কত হবে? চায়ের ফলন ভাল হলে, বিক্রিবাটা ঠিক থাকলে ভাল বোনাস। সে বার তো ২০% বোনাস ছিল। বাবা মায়ের জন্য সিল্ক আনল। দিদি এসে সেই আশ্চর্য গল্পটা করল— বাবা কী করেছে জানো মা? শাড়ির সুতো বের করে দেশলাই জ্বেলে ফস্ করে সুতোয় আগুন দিয়ে দিল। তারপর গন্ধ শুঁকল কয়েক বার। একেবারে চুলপোড়া গন্ধ মা। তার মানে সত্যিকারের রেশম!

শাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। দিদি যখন বড় হল, পরত। ওর বিয়ে হয়ে গেল, তখন আমিও পরেছি। একদিন ছিঁড়ে গেল। সবই জীর্ণ পুরাতন হয়। পরিবর্তনের অভিমুখও অনিশ্চয়। আমাদের স্বপ্নোজ্জ্বল চা বাগানগুলি ধুঁকছে। কালচিনির মণ্ডপ ভেঙে পড়েছে। পূজাও আর হয় না। পুজোর সময় শেষ বোধহয় গিয়েছিলাম বারো বছর আগে। কোথায় সেই সুবিশাল প্রতিমা, কোথায় আনন্দের তরঙ্গায়িত দুপুর বিকেল রাত্রি! একেবারে দেড় হাত মূর্তিখানি দেখিয়ে দাদা বলল, কেমন রে?

বললাম, বেশ!

কিন্তু পূজার সেই দৈন্য বড় ভার হয়ে রইল মনে। বিষম সে ভার! মহালয়া শোনার উৎসাহ নেই। অঞ্জলি দেবার তাগিদ নেই। চা বাগান ছেড়ে কবেই কলকাত্তাইয়া হয়ে গিয়েছি। তবু কি চা বাগান ছাড়া যায়? এখানে-ওখানে চায়ের দোকান, ঘরে ঘরে চা পানের অভ্যাস, আন্তর্জাল তথ্যভাণ্ডারে চা পানের কত না উপকারিতা! তা হলে, বলো মা দুর্গা, চা বাগানগুলির এ দুর্গতি কেন?

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

Durga Puja 2019 Ananda Utsav 2019 Durga Puja Celebration Tilottama Majumdar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy