Advertisement
Durga Puja 2020

পুজোর হাওয়া আর পোড়-খাওয়া চিরকুটের গল্প

আজ যখন ল্যাপটপের ফর্সা স্ক্রিনে ফুটে উঠছে এই লেখা আর বাইরে গন্ধ পাচ্ছি পুজোর, ওই পোড়-খাওয়া চিরকুটটার কথা খুব মনে পড়ছে।

শ্রীজাত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০১:০০
Share: Save:

অন্যান্যবার পুজোর স্মৃতি ঝালিয়ে নেবার তবু কিছু উপায় থাকে। হয়তো একেবারে আগের মতো হয় না সবটা, কিন্তু ফেলে আসা সময়ের পাশের পাড়া দিয়ে ঘুরে আসার একখানা তাগিদ তো থাকেই প্রতিবার। একটা নতুন ফতুয়া অন্তত গায়ে চাপানো, আর পুজোর রোদ লাগিয়ে বেরিয়ে পড়া, এই বা কম কী। বা ধরা যাক, রাত আটটার তুমুল ভিড় এড়িয়ে নিভৃত কোনও ফুচকাওলার কাছ থেকে কুড়ি টাকার জলভরা খেয়ে একটা শুকনো ফাউ। অতীতের পুজোর কাছে পৌঁছনোর এসবই তো উপায়। নাহ, সারা রাত ভিড় ঠেলে কলকাতা চষা যেমন শরীরে বা মনে দেয় না আর, তেমনই রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আচ্ছা করে চিলি সস দেওয়া চিকেন রোলও নামে না গলা দিয়ে। কিন্তু কমসম করেও স্মৃতির পুজোকে ঝালিয়ে নেওয়া যায়। এ-বছর এমন এক অসুখ ঘিরে ধরল আমাদের যে, সেটুকু উপায়ও আর বাকি থাকল না। অন্তত আমার মতো মানুষের এবারের পুজো বেশ নির্জনেই কাটবে।

কিন্তু সেই নির্জনে কাটানোরও মজা আছে নিশ্চয়ই। আর তা হল, বাড়িতে চুপটি করে বসে, ফেলে আসা পুজোদের এক একটা স্মৃতি সেলাই করে নতুন ভাবনার পোশাক বানানো। সেইটাই আমার এবারের পুজোর নতুন জামা। ইদানীং খুব মনে পড়ে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরনোর সেইসব সন্ধেগুলো। বয়স যত বাড়ছে, বন্ধু তত কমছে বলেই বোধহয়। এই ব্যস্তানুপাতিক সমীকরণ কষতে বসে উত্তরের কাছে আর পৌঁছতে ইচ্ছে করে না। বরং মাঝেই কোনও জনহীন স্টেশনে নেমে পড়া ভাল, যেখানে একটু পরে এসে ধোঁয়া ছাড়বে স্মৃতির রেলগাড়ি।

আমার মতো মানুষের এবারের পুজো বেশ নির্জনেই কাটবে।

তেমনই কোনও গাড়িতে চেপে আজ পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করে এগারো বা বারো ক্লাসের পুজোর দিনগুলোয়, যখন বন্ধু মানে কেবলই বন্ধু, পুজো মানে কেবলই ছুটি, আর রাংতা মানে কেবলই স্বপ্নের মোড়ক। তখন গড়িয়া অঞ্চলে থাকি। এদিকে এগোলে যাদবপুর আর ওদিকে এগোলে রানিকুঠি, এর মধ্যেই স্কুলের সেরা বন্ধুদের ঠিকানা। বান্ধবীদেরও। আমার অবশ্য চিরকালই মনে হতো, বান্ধবীদের কোনও ঠিকানা হয় না। তারা ছদ্মবেশে আসে, আর বারেবারে ফেরার সময়ে তাদের বাড়ি বদলে যায়। গেটের পাশে চাঁপাগাছে ফুল আসে, পাঁচিলের মাথায় এসে বসে নতুন চড়াই, বা কার্নিশে মেলা হয় এমন একখানা ওড়না, যা আগে কেউ দ্যাখেনি। এভাবেই তাদের ঠিকানা বদলে যায় বারবার, নতুন হয়ে ওঠে রোজ রোজ। তেমন সব বান্ধবীরাও দল বেঁধে বেরোত বৈকি পুজোর ঝলমলে সেই সন্ধেগুলোয়, আর আমরাও ঝাঁক বেঁধে ঝাঁপাতাম ভিড়ে, নতুন শাড়ির আশেপাশে জলফড়িং-এর মতোই ঘুরঘুর করব বলে।

আরও পড়ুন: পুজোর আনন্দের মধ্যেই ছিল পরীক্ষার ভয়ের কাঁটা

তখন পুজোদের মধ্যে এত রেষারেষি ছিল না, আমাদেরও মেশামেশি ছিল দিব্যি। তাই অমুক পুজো দেখতেই হবে বা তমুক পুজো না দেখলে জীবন বৃথা, এই দৌড়ের মধ্যে আমরা পড়িনি। আমাদের ছিল হাঁটতে হাঁটতে দেখে ফেলা যে-কোনও পুজোর জৌলুস, আমাদের ছিল পাড়ায় হারাতে হারাতে ছুঁয়ে ফেলা অল্প রোশনাইয়ের জমায়েত। সেসব পাড়া এখনও আছে নিশ্চয়ই, আমরাই হারাতে হারাতে একে অপরের থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। মাঝারি পুজো, তাকে ঘিরে কতশত চলতি দোকানির ভিড়, কেউ চুড়ি তো কেউ ঘুগনি, কেউ বেলুন তো কেউ আইসক্রিম। লোকজনের ঠেলাঠেলিতে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে একটু এগিয়ে থাকা সেই বান্ধবীর দিকে, ক্লাসে যার প্রতি চাহনি তোলার সাহস হয় না। তর্কে জড়িয়ে পড়ছি দুর্দান্ত রেজাল্টের বন্ধুর সঙ্গে, অন্য সেকশনের ছেলে হলেও যে বেরিয়েছে আমাদের সঙ্গেই। সারা বছর যেসব কাঁটাতার মেনে চলতাম, পুজোর সময়ে তাদেরই জড়িয়ে নিতাম অদৃশ্য মুকুটের মতো।

আমাদের ছিল পাড়ায় হারাতে হারাতে ছুঁয়ে ফেলা অল্প রোশনাইয়ের জমায়েত।

নতুন জুতো হয়তো হয়নি, মেজেঘষে নিয়েছি ভাল করে, যাতে চকচক করে। কেউ হয়তো সপ্তমীর জামাটাই আবার ইস্ত্রি করে পরে এসেছে। ‘তুই এই শাড়িটা ফ্রেশার্সে পরেছিলি না?’ উত্তরে শোনা যাচ্ছে, ‘তো কী, পুজোরই শাড়ি’। এই ছিল আমাদের তৈয়ারি। কিন্তু যেটা সত্যিকারের নতুন ছিল, সেটা হল ওই আশ্চর্য ভাললাগা, যার জন্য সারা বছরের অপেক্ষা। ভিড়ভাট্টার পুজোতে তো ছিটকে গেলাম এদিক সেদিক। আবার জড়ো হলাম পাড়ার ভেতরকার এক নিরিবিলি পুজোয়। কোনও আড়ম্বর নেই, জৌলুস নেই, লোকজনের ভিড় নেই, জোনাকি আর টিউব পাল্লা দিয়ে জ্বলছে, সাউন্ডবক্সে সদ্য হিট হওয়া ছবির গানে শানু-অলকা জুটি। একটু একটু ঠান্ডা যেন পড়তে শুরু করেছে,একখানা ঢাক কাঠি মাথায় ক্লান্ত দাঁড়িয়ে একপাশে, বাজনদার হয়তো চা খেতে গিয়েছেন সামনেই। এই সুযোগ, ফ্রেশার্সের শাড়ি পরে চলে আসা অলীক ওই মেয়েটির হাতের ফাঁকে চিরকুট গুঁজে দেবার। বন্ধুরা একটু এগিয়ে গিয়েছে, প্রতিমার সামনে। বান্ধবীটির চটি কীসে যেন আটকেছে। সেই সুযোগে, অচেনা সেই চটিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে, ‘অ্যাই শোন, এটা বাড়ি গিয়ে পড়িস কিন্তু’।

আরও পড়ুন: মিষ্টি হেসে বলল... হ্যাপি পুজা!

ব্যাস। পুজো কিন্তু ওখানেই থমকে থাকল সে-বছর। এগোল না ভিড়ের মধ্যে, ফিরল না কোনও নির্জনে। আর থমকে থাকল নড়বড়ে হাতের লেখায় ভর্তি একখানা চিরকুট, নরম আর ঘেমে ওঠা এক হাতের পাতায়, যে নাকি এই গ্রহের নয়। আজ যখন ল্যাপটপের ফর্সা স্ক্রিনে ফুটে উঠছে এই লেখা আর বাইরে গন্ধ পাচ্ছি পুজোর, ওই পোড়-খাওয়া চিরকুটটার কথা খুব মনে পড়ছে। বোকাই ছিলাম কেমন যেন, বোকাই থেকে গেলাম হয়তো। কেবল কয়েকটা চিরকুট হারিয়ে গেল পুজোর ঠান্ডা হাওয়ায়। এ-গ্রহে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE