প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

আমার দুর্গা...

এনজেপি স্টেশনে নামছি, হঠাৎ কানে এল, ‘‘দিদি, দু’প্যাকেট ধূপকাঠি নেবে? পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা।’’

নবনীতা গুহ

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ১০:৪৭

রাঙাপানি পেরিয়ে ট্রেন যখন এগিয়ে চলত, তখন থেকেই ভেসে আসত গন্ধটা... বাড়ি এসে গেল! শরতের সকাল হলে তো কথাই নেই। বাড়ি আর পুজোর গন্ধ মিলেমিশে একাকার।

কত দিন হবে? বছর পনেরো-ষোলো হয়তো। এনজেপি স্টেশনে নামছি, হঠাৎ কানে এল, ‘‘দিদি, দু’প্যাকেট ধূপকাঠি নেবে? পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা।’’ বাড়িতে পুজোআর্চার বিশেষ চল নেই। ট্যাঁকে তখন দশ টাকাও অনেক। তা ছাড়া, ঠাসা ব্যাগ কোনও ভাবে বন্ধ করেছি, এখনই নামব। রাখবই বা কোথায়! জানলার বাইরে থেকে জলভরা চোখ বলে উঠল, ‘‘নেবে না?’’ দশ টাকা বার করে বললাম, এমনিই নে, ধূপ চাই না। সরু কাঠির মতো হাতগুলো আমার দু’হাত চেপে দু’টো প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘এ আমার রোজগারের টাকা দিদি। পুজোয় একটা নতুন জামা কিনব।’’ মুখে একরাশ হাসি নিয়ে দে ছুট! থমকে দাঁড়িয়ে আমি। কোথায় আলো, কোথায় মণ্ডপ। এই তো আমার দুর্গা!

আর এক পুজোয়...। পুজোর ছুটিতে বাবার মোমোর দোকানে সাহায্য করছিল সে। ছোট্ট হাত খদ্দেরদের সামনে এগিয়ে দেয় সস্‌ মাখানো মোমোর প্লেট। জিজ্ঞাসা করে, আর স্যুপ লাগবে? তবে সন্ধ্যা হলেই খুদে খুদে চোখ টানে বেলুন, বাঁশির দিকে। ‘‘বাবা, কিনে দেবে না?’’ শান্ত গলায় বাবার উত্তর, ‘‘ফেরার দিন দেব একটা।’’ পরে তিনি বলেন, ‘‘পাহাড় থেকে এত দূর এলাম। পুজোর সময়ে একটু বেশি বিক্রি হয়। তা দিয়েই সংসার, মেয়ের লেখাপড়া। মেয়ে আমার মা দুর্গা। লিখিয়ে-পড়িয়ে বড় করতে হবে না!’’

আরও পড়ুন: প্লাস্টিক বর্জন করল এই পুজো কমিটিগুলি​

আরও পড়ুন: বারো ইয়ারি আয়োজনে পূজিতা হন গুপ্তিপাড়ার বিন্ধ্যবাসিনী​

সে বারে বিশাল মাঠে পুজোর আড্ডায় ঘুরে ঘুরে চা বেচছিলেন এক জন। না নিতে চাইলে দাম কমিয়ে দিতেও রাজি। অনুরোধ রাখতে খেলাম একটা। চা বানাতে বানাতে জানালেন, চা শ্রমিক তিনি। বাগানের অবস্থা ভাল নয়। পেটের দায়ে তাই পুজোর শহরে আসা। চা বানিয়ে যদি দু’টো টাকা মেলে!

চোখে ভাসে এখনও সেই অষ্টমীর সন্ধে। পাটভাঙা শাড়িরা বেরিয়ে পড়েছে পাঞ্জাবিদের হাত ধরে। পাড়ায় চলছে ধুনুচি নাচ। হঠাৎ দেখি বাদল ঢাকির চোখে জল। মালদহ থেকে আসেন, প্রত্যেক বার। সঙ্গে থাকে দশ বছরের ছেলে। নাচ শেষে ঢাক রেখে জল খাচ্ছিলেন। সামনে যেতেই জল মুছে শুকনো হাসলেন, ‘‘কলকাতায় কেমন লাগছে দিদি?’’ তোমার ছেলে কই বাদলদা? ‘‘দু’দিনের জ্বরে সব শেষ। না হলে প্রতি বছরই তো আসে। যাওয়ার সময়ে ওর জামা কেনার আগে মায়ের জন্য শাড়ি কেনে। এ বছর আর হল না! ওর মা তো আমাকে এ বার আসতেই দিচ্ছিল না। কিন্তু মন না মানলেও পেট তো চালাতে হবে!’’ ধূপের ধোঁয়ায় ঢেকে যায় বাদলদার চোখ। ঢাক তুলে নেয় কাঁধে। পরের দল নাচতে চলে এল যে।

এখনও মনে পড়ে সেই নবমীর রাত। বাড়ি ফেরার সময়ে হসপিটাল মোড়ে হঠাৎ দেখা প্রতীকদার সঙ্গে। ছুটছেন হন্তদন্ত হয়ে। পুজোয় শহর ছাড়িয়ে ডুয়ার্সের দিকে যাচ্ছিলেন ওঁরা। হঠাৎ কান্নার আওয়াজে গাড়ি থামান। রাস্তার পাশে পড়ে আছে সদ্যোজাত মেয়ে। সদ্য নাড়ি কাটা হয়েছে। ‘‘হাসপাতালে নিয়ে এলাম রে, বাঁচবে কিনা জানি না!’’

ঘুম হয়নি সেই রাতটায়। মেয়ে হলে বুঝি ফেলে দিতে হয়! ঘুম যখন ভাঙল, মনে পড়ল আজ দশমী, মন জুড়ে তখন কালো মেঘ। মা দুর্গা না হয় শ্বশুরবাড়ি যাবেন, আর সেই মেয়ে? সকাল সকাল বিসর্জনের পরে ঘটের জলে যখন মায়ের মুখ, মনে মনে বললাম, সুস্থ হয়ে ওঠ মেয়ে। লড়তে তোকে হবেই! বেরতেই পাড়ার রিকশাদাদার সঙ্গে দেখা। সিটের তলা থেকে ছোট্ট প্যাকেট বার করে হাতে গুজিয়া ধরিয়ে দিলেন। সঙ্গে হাসি, ‘‘মেয়ে হয়েছে। তাই মিষ্টি। বড় স্কুল, বড় কলেজে পড়াব।’’

মন, চোখ জুড়ে তখন জলে দেখা দুর্গা মায়ের মুখ, আর কানে বাজছে, ‘যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে...।’

চিত্রণ: অমিতাভ চন্দ্র

Durga Puja Celebration 2018 Durga Puja Special Durga Puja Nostalgia Kolkata Durga Puja Durga Puja Preparations
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy