প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

পুজোর বৃষ্টিতে ভেজা পিঠ, মুখে অন্য এক নক্ষত্রের হাসি

শরতের অসময়ের বৃষ্টিটি না হলে একই ছাতার নীচে হাতে হাত ঠেকিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটাই হয়তো তাদের কাছে অজানা থেকে যেত।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:১১

পুজোর সময় আগেও বৃষ্টি হত। এখনও হয়। কিন্তু এদের মধ্যে একটা তফাত আছে। আমাদের ছোটবেলায় শরৎকালের এই বৃষ্টির ধরনটা ছিল চঞ্চল কিশোরীর মতো। এই আসছে তুড়ুক্‌, ওই যাচ্ছে ফুড়ুক্‌! এই দেখছি ঝকঝকে নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো সাদাসাদা মেঘ, হঠাৎ ঝমঝম করে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আকাশে রোদ্দুর রয়েছে অথচ বৃষ্টি হচ্ছে, এমনটা তো শরৎকালেই বেশি দেখা যেত। অথচ বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি, পুজোর সময়টায় আকাশ কালো করে একদম মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগে, এই কি আমাদের শরৎকাল? এ আসলে বোধহয় সেই গোমড়ামুখো বর্ষাকাল, যে নিজের মুখে শরৎকালের একটা হাসিহাসি মুখোশ পরে আছে।

ইদানীং শরতের বৃষ্টিতেও রাস্তাঘাটে জল জমে যায়। জলে কাদায় গদগদে হয়ে যায় পুজোর জন্য সেজে ওঠা পার্কগুলোর মাটি। যদি পার্কের মাঝখানে প্যান্ডেল হয়, তবে জল-ছপছপে মাঠের মধ্যে সেই প্যান্ডেলটাকে যেন একটা আলোকিত জাহাজের মতো লাগে। মাঠের জলে নানারঙের আলোকমালার ছায়া পড়ে ঝলমল ঝলমল করে। পুজোর উদ্যোক্তারা মাঠের জল ঢাকবার জন্য তড়িঘড়ি বস্তা বস্তা বালি ফ্যালেন। প্যান্ডেলে পৌঁছবার জন্যে ইটের সেতু তৈরি করে দ্যান। তার ওপর দিয়ে দর্শনার্থীরা ‘কুমির তোর জলকে নেমেছি...’ স্টাইলে ব্যালান্স করে হেঁটে প্যান্ডেলে গিয়ে ওঠেন। আর একটু পা-ফস্কালেই ‘ফচাৎ!’

লাস্ট বছর দশেক ধরে পুজোর কিছু দিন আগে থেকে আমরা রাস্তাঘাটে, মেট্রোয় বা বাসে যে শব্দ দুটো একটু বেশি বেশি শুনতে পাচ্ছি, তারা হল ‘নিম্নচাপ’ আর ‘ঘূর্ণাবর্ত’। আমাদের ছোটবেলায় এই নিম্নচাপের প্রকোপ হয়তো কিছুটা কম ছিল, তাই এর নাম তখন খুব বেশি শুনেছি বলে মনে পড়ে না। এখন যেহেতু আবহাওয়া দফতর খুবই সক্রিয়, তাই তারা মাসখানেক আগে থেকেই তাদের পূর্বাভাষ সব জায়গায় ফলাও করে রটিয়ে দিয়ে থাকে। যদিও নিন্দুকেরা বলে, কলকাতার আবহাওয়া দফতরের যে কোনও ঘোষণাকেই উল্টে নিয়ে পড়তে হয়। মানে, বৃষ্টি হবে বললে ধরে নিতে হয় খটখটে শুকনো দিন আর মেঘমুক্ত আকাশ বললে তৈরি থাকতে হয় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির জন্য— তবু পুজোর সময় আমরা কিন্তু শুকনো-শাকনা দিন কাটানোর ফোরকাস্ট-ই পেতে চাই তাদের কাছ থেকে।

পুজোর আগে ঘ্যানঘ্যানে টাইপের বৃষ্টি হলে পুজোর বাজারের খুব মুশকিল হয়। ক্রেতা এবং বিক্রেতা দু’জনেরই মুখ আকাশের মতো থমথম করে। বিশেষ করে ফুটপাতে বসা যে সব দোকানদার পুজোর এই ক’টা দিনের বিক্রিবাটায় সামান্য লাভ করার আশায় সারা বছর অপেক্ষা করেন, তাঁদের কথা চিন্তা করলেই বৃষ্টিকে, নরেশ মিত্তির বা উৎপল দত্তের চেয়েও নিষ্ঠুর জমিদার বলে মনে হয়। ও দিকে রঙিন প্লাস্টিক টাঙানো পোটোপাড়া বা কুমোরটুলিতে, স্টোভ বা হিটারের আঁচে মূর্তির কাঁচামাটি শুকনোর কাজ চলতে থাকে। প্যান্ডেলের ফাইনাল টাচ, লাইট লাগানো, বিজ্ঞাপনে হোর্ডিং আটকানো, চাঁদা তোলা— সমস্ত কিছুই বৃষ্টির দাপটে কেমন যেন মিইয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: অ্যাসিড-মেয়ে পারমিতার উত্তরণ আজকের দুর্গায়

পুজোর দিনগুলোয় বৃষ্টি হলে সবচেয়ে মনখারাপ হয় ছোটদের। কারণ তারা দারুণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কবে পুজো আসবে, আর তারা নতুন জামাকাপড় আর জুতো পরে ঠাকুর দেখতে বেরবে। বিভিন্ন পার্কে টয় ট্রেন, মেরি-গো-রাউন্ড বা ময়ূরপঙ্খীর মতো যে রাইডগুলো থাকে, বৃষ্টি পড়লে সেগুলোয় তাদের চড়া হয় না। এমনিতেই পুজোর সময় কলকাতায় জ্যামজট লেগেই থাকে। আত্মীয়বন্ধুরা মিলে গাড়ি ভাড়া করে পুজোর সময় যারা সারারাত ঠাকুর দেখতে বেরয়, তাদের ঠাকুর দেখার স্পিড বৃষ্টির জন্য আরও যেন কমে আসে। একটা সময়ের পর তারা এটাই বুঝতে পারে না, গুড়গুড় করে এগিয়ে চলা একটা মোটরগাড়িতে চড়ে তারা ঘুরতে বেরিয়েছে, নাকি দুটো সাদা রঙের ক্লান্ত বলদে টানা গরুরগাড়িতে!

পুজোর আনন্দময় দিনগুলোয় বৃষ্টি নামলে মানুষ সেজেগুজে বাড়ির জানলা বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ধরে যাওয়ার অপেক্ষা করে। বৃষ্টি একটু কমলেই দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। আবার যেই বৃষ্টি শুরু হয়, অমনি মাথা বাঁচাতে ঢুকে পড়ে হাতের সামনের কোনও একটা প্যান্ডেলের মধ্যে। ঢুকে, রুমাল দিয়ে মাথা-টাথা মুছে দাঁড়িয়ে পড়ে প্যান্ডেলের কোণগুলোয় রাখা বড় বড় পেডেস্ট্রাল ফ্যানের সামনে। সেই প্যান্ডেলে যদি আবার এক দিকের প্রবেশ দরজা দিয়ে ঢুকে, অন্য দিকের প্রস্থান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, আর মাঝখানের জায়গাটিতে কালো পোশাক-পরা সিকিউরিটির দল, ‘দাঁড়িয়ে পড়বেন না... সেলফি তুলবেন না... হাঁটতে থাকুন... এগতে থাকুন!’ গোছের বাণী ক্রমাগত আওড়াতে আওড়াতে প্যান্ডেল থেকে সবাইকে আবার সেই বাইরের বৃষ্টির মধ্যেই খেদিয়ে বের করে দ্যায়, তখন নতুন শাড়ি-জামার ন্যাতাকানি হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকে না।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া পুজোর ভোগের রান্না​

পুজোর সময় মণ্ডপের আশপাশে অস্থায়ী ছাউনিওয়ালা খাবারের স্টলগুলোয় কিন্তু সারারাত লোক গিসগিস করে। বৃষ্টি এড়াতে তাতে ঢুকে পড়লে, রংচটা লাল ফাইবারের টেবিল-চেয়ারে বসে চাউমিন বা বিরিয়ানির মতো কিছু না কিছু তো অর্ডার দিতেই হয়, কারণ বিনি অর্ডারে সেখানে বসবার তো কোনও নিয়ম নেই। খাবার খেতে খেতে দেখা যায়, রাস্তা দিয়ে হেঁটে-চলা বৃষ্টিভেজা রঙিন ছাতার মেলা। দেখা যায়, কী ভাবে কাদা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে সবাই! ছোট ছেলেমেয়েদের এক হাতে কোলে নিয়ে, অন্য হাতে ছাতা আঁকড়ে হেঁটে চলেছে তার বাবা কিংবা মা। সন্তানের মাথা বাঁচাতে গিয়ে তাদের পিঠ ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির ছাটে। তাই মুখে বেশ কিছুটা বিরক্তি। একই ভাবে আংশিক পিঠ ভিজিয়ে জোড়ায় জোড়ায় হেঁটে যাচ্ছে সদ্য স্কুল পেরনো ছেলেমেয়ের দল। প্রতি দু’জনের মাথায় একটিই মাত্র কমন ছাতা। কিন্তু মুখে... অন্য এক নক্ষত্রের হাসি। চোখে অচেনা এক গ্রহের উজ্জ্বলতা। পুজোর এই বৃষ্টিকে তারা মনে মনে নিঃশব্দে ঠাকুর ভেবেই প্রণাম জানায়। কারণ, শরতের এই অসময়ের বৃষ্টিটি না হলে, একই ছাতার নীচে, জোড়ায়-জোড়ায় হাতে হাত ঠেকিয়ে, জীবনে প্রথম বার এই ভাবে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটাই হয়তো তাদের কাছে অজানা থেকে যেত।

কার্টুন : দেবাশীষ দেব

Anada Utsav 2019 Durga Puja 2019 Durga Puja Celebration
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy