Advertisement
E-Paper

বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো

বাড়ির কাছেই বেল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তন্ত্রমতে পূজা করেন গোপীনাথ। 

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২০ ২১:১৪
Share
Save

সময়টা ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ। বাংলায় তখন শাক্ত-বৈষ্ণবের ঘোর বিরোধ। শ্রীচৈতন্যের ভক্তিরসে তখন ডুব দিয়েছে বাংলা। অন্য দিকে বীরাচারী তান্ত্রিকেরা মেতে রয়েছেন শবসাধনা, নরবলি ইত্যাদি নানা ভয়ঙ্কর গুহ্য ক্রিয়াকলাপে। সেই সময় কালী পুজিত হতেন মূর্তিতে নয়, শিলাখণ্ড, যন্ত্র এবং ঘটে। তাও আবার বাড়িতে নয়, লোকচক্ষুর অন্তরালে পুজো হত শ্মশানে, নদীতীরে কিংবা জঙ্গলে। এমনই এক সময় কালীর রূপটি কেমন তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। দীর্ঘ সাধনার পরে এক রাতে কৃষ্ণানন্দ দ্বৈববাণী শুনতে পান যে ভোরের প্রথম আলোয় তিনি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ।

পর দিন ভোরে কৃষ্ণানন্দ গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার পথে দেখা পান এক বাগদী মহিলার। তিনি আপন মনে কুটিরের দেওয়ালে গোবরের প্রলেপ দিতে ব্যস্ত ছিলেন। কৃষ্ণানন্দকে সামনে দেখে সেই বধূ লজ্জায় জিভ কাটলেন। কৃষ্ণানন্দ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ে গেল সেই দ্বৈব স্বপ্নের কথা। সেই রমণীর মাঝেই তাঁর আরাধ্য দেবীর কালীর অদেখা রূপটি দেখতে পেলেন। কিংবদন্তি, কৃষ্ণানন্দই মাটির কালীমূর্তি গড়ে পুজোর প্রচলন করেন। তিনিই গৃহী মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অতি গোপন কালীপুজোর পদ্ধতি। এ সব কিছুর ঘটনাস্থল বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপ। কৃষ্ণানন্দকে অনেকেই শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক মনে করেন। আবার কারও মতে তিনি চৈতন্য পরবর্তী যুগের মানুষ। নবদ্বীপের আগমেশ্বরী পাড়ায় কৃষ্ণানন্দ প্রবর্তিত এবং প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে আজও পঞ্চমুণ্ডির আসনে কালীপুজো হয়ে আসছে। এর পর ভাগীরথী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল।

শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী শাক্ত-বৈষ্ণব বিরোধ মেটাতে কৃষ্ণানন্দের প্রপৌত্র সর্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এতে নবদ্বীপের তৎকালীন শাক্ত সমাজ সর্বভৌমকে একঘরে করে সমাজচ্যূত করায় মথুরেশ তাঁর মেয়ে জামাইকে শান্তিপুরে নিয়ে আসেন। এর পর সর্বভৌম বড়গোস্বামীবাড়ির অদূরে মঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সেখানে কালীপুজোর প্রচলন করেন।

আরও পড়ুন: কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় জড়িয়ে আছে কৃষি সমাজের সমৃদ্ধির কামনা

শান্তিপুরের বড়গোস্বামী পাড়ায় পূজিত কালীমূর্তির নাম আগমেশ্বরী

বড়গোস্বমী পরিবারের সদস্য ও আগমেশ্বরী পুজো কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা সত্যনারায়ণ গোস্বামী জানালেন, শান্তিপুরের বড়গোস্বামী পাড়ায় পূজিত সেই কালীমূর্তির নামও আগমেশ্বরী। অতীতে এই পুজোয় কার্তিকী অমাবস্যায় এক দিনে মূর্তি গড়ে পুজোর রীতি ছিল এবং সূর্যোদয়ের আগে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হত। এখন আগে থেকে মূর্তি তৈরি হলেও পুরোহিত পুজোয় বসার আগে দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পুজোর পর দিন আগমেশ্বরীর বিসর্জন দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। বাংলার অন্যত্র পুজিত কালীমূর্তির থেকে আলাদা আগমেশ্বরী। দেবীর কানে থাকে দু’টি বালকের শবের প্রতিমূর্তি এবং কানে থাকে তীর। এ বার করোনা আবহে রীতি মেনে পুজো হলেও থাকছে নানা সতর্কতা। পুজো দেওয়া এবং দর্শনার্থীদের মধ্যে ভোগ বিতরণ এ বছর বন্ধ থাকবে।

আগমেশ্বরী ছাড়াও এখানে বেশ কিছু প্রাচীন পারিবারিক কালীপুজো হয়। যেমন চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজো। এই পুজো শুরু করেন গোপীনাথ সার্বভৌম। সেই নিয়েও রয়েছে এক কাহিনি। আজ থেকে প্রায় ২২ পুরুষ আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ গোপীনাথ সার্বভৌম এক দিন বাড়ির নারায়ণ শিলা পুজোয় আয়োজনে ব্যস্ত। এমন সময় একটি ছোট মেয়ে এসে তাঁর কাছে প্রসাদ চাইলো। গোপীনাথ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আগে পুজো হোক তার পরে সে প্রসাদ পাবে। কিন্তু মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। তখনই তার প্রসাদ চাই। এতে বিরক্ত হয়ে গোপীনাথ মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেন। পুজো শেষে গোপীনাথ প্রসাদ নিয়ে মেয়েটির অনেক খোঁজ করলেও তার আর সন্ধান পাননি। সেই রাতেই গোপীনাথ স্বপ্নে দেখা পান সেই মেয়েটির। তিনি আর কেউ নন দেবী কালী। গোপীনাথ তাঁর কাছেই আদেশ পান বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে ‘মা চাঁদুনী’ নামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে কার্তিকী অমাবস্যার রাতে পুজো করার।

পর দিন গোপীনাথ সেই স্বপ্নের কথা তাঁর মাকে জানিয়ে বায়না ধরেন স্বপ্নে দেখা সেই মূর্তি তৈরি করে দেওয়ার জন্য। তাঁর মা ধীরে ধীরে সেই মূর্তি নির্মাণ করে দেন। বাড়ির কাছেই বেল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তন্ত্রমতে পূজা করেন গোপীনাথ। পরবর্তীকালে এই গোপীনাথ হয়ে ওঠেন পণ্ডিত এবং তন্ত্রসাধক। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গোপীনাথের ভাই কাশীনাথ সার্বভৌম ছিলেন শ্রীচৈতন্যের গৃহশিক্ষক। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শান্তিপুরে আসেন কাশীনাথের সঙ্গে দেখা করতে।

জজ-পণ্ডিত বাড়ির পূজিত দেবীর নাম পক্কানেশ্বরী কালী

কালের প্রবাহে অনেক পরিবর্তন এলেও অতীতের সব রীতি মেনে আজও পুজো হয়। বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির বড় বউ দেবীর গায়ে মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। শান্তিপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা যে যেখানেই থাকুক না কেন পুজোয় চলে আসেন এখানে। শান্তিপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাড়িটির নাম ‘চাঁদুনীবাড়ি’ আর পাড়ার নাম ‘চাঁদুনীপাড়া’। সাবেক প্রথা মেনে কালীপুজোর দিন সকালে সোনার গয়না পরানোর পরে বাড়ির ছেলেদের কাঁধে চড়ে দুর্গাদালান থেকে নিজের পঞ্চমুণ্ডির আসনে যান দেবী। চলতি কথায় একে বলে পাটে ওঠা। সে সময় মন্দির প্রাঙ্গণে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।

এই পরিবারের সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “এক বার দেবীর স্বপ্নাদেশ হয়, পাটে ওঠার সময় রোদের মধ্যে তাঁর খুব গরম লাগে, তেষ্টা পায়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হল রুপোর ছাতা, রুপোর পাখার। আর মন্দিরে প্রবেশের আগে দেবীকে শীতলভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে।” তাতে থাকে ভিজে মুগডাল, ডাবের জল, বেলের পানা, তরমুজ, শসা, ঠান্ডা দই-মিষ্টি ইত্যাদি। এখনও নিয়ম অনুযায়ী একাদশী তিথিতে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে বসে নহবতের আসর। প্রত্যেক দিন ৮ প্রহর নহবত বাজানো হয়। পুজোর আগের দিন সন্ধ্যাবেলা দেবীকে পরানো হয় ডাকের সাজ। পাশাপাশি বাড়ির ছেলেরা পাটের চুলে জবাকুসুম তেল মাখিয়ে তা দেবীকে পরানোর জন্য প্রস্তুত করেন।

কালীপুজোর দিন পাটে ওঠার পরে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। চণ্ডীপাঠের পরে বাড়ির সদস্যদের নামের খাঁড়া-সরা পুজো হয়। বাড়ির দীক্ষিত বউরা ভোগ রান্না শুরু করেন। ভোগের ঘরেই করা হয় দেবীর বিশ্রামের ব্যবস্থা। সেখানে দেওয়া হয় রঙিন শাড়ি, নরম বিছানা, তালপাতার পাখা, দাঁত খোঁচানো কাঠি। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর পর রাত ১২টায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে দেবীর পুজো শুরু হয়। এই পুজো করেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ দীক্ষিত পুরুষ। পুজো হয় পারিবারিক পুঁথি মেনে। পুজোয় আজও পশুবলি হয়। বহু ভক্ত ও বাড়ির পুরুষ-মহিলারা দেবীর সামনে সামনে ধুনো পোড়ান এবং নিজেদের বুক চিরে রক্ত দেন। এর পর হোম ও ঘট বিসর্জন হয়।

এই পুজোর আরও একটি অঙ্গ হল নৈবেদ্য সাজানো। নানা ধরনের ফল, মিষ্টি দেবীকে দেওয়া হয়। ভোগের ক্ষেত্রেও থাকে নানা ব্যাঞ্জন। গজা আর পক্কান্ন হল পুজোর প্রধান প্রসাদ। পরের দিন ঠিক দুপুর ১২টায় বাজনা বাজিয়ে দালান থেকে প্রসাদী জিনিস তুলে ফেলা হয়। একে বলে ভাঙ্গা বাসর। সন্ধ্যে ৬টায় দেবীকে বরণ করেন বাড়ির বউরা। রাত ৯টা নাগাদ আলোকসজ্জা-সহ প্রতিমা নিরঞ্জনে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও বাহকের কাঁধে দেবী বিসর্জনে যান। এই সময়ে মাঝ পথে একটি পরিবার থেকে দেবীকে মিষ্টি ও জল নিবেদন করা হয়। ঘাটে পৌঁছনোর বেশ কিছুটা আগে বাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ বিসর্জনের জন্য শোক পালন করা হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে কাঠামোটি আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। যেহেতু দুর্গা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কালীর আবাহন শুরু হয় তাই এই বাড়িতে বিজয়া দশমী উৎসব পালন করা হয় না। কালীপুজার পরের দিন বিজয়া পালন করা হয়।

মহিষখাগীর পুজোতে আগে মহিষ বলি হত

শান্তিপুরের আরও একটি প্রাচীন পুজো ঠাকুরপাড়ার জজ-পণ্ডিত বাড়ির পুজো। দেবীর নাম পক্কানেশ্বরী কালী। এই পরিবারের পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায় পুজো শুরু করেন। তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে জজ-পণ্ডিত উপাধি পেয়েছিলেন। এই পরিবারের গৌতমকুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন, “দেবীর পাটে ওঠার সময় একটি পাঁঠাবলি হয়। সম্পূর্ণ তান্ত্রিক বিধিতে পুজো হয়।” অতীতে এই পরিবারে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো হত। রাত ১২টায় পুজো শুরু হয়। ভোগে অন্ন, শুক্তো, পাঁচ ভাজা, বিভিন্ন রকম ডালনা, তরকারি, মাছ, মাংস, মিষ্টি, পায়েস দেওয়া হয়। এক আসনে পুজো নয়, পরের দিন সকালে বিসর্জনের আগে পুজো হয়। এই পুজোয় প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় পক্কান্ন। দুপুরে দেবীকে বেদী থেকে নামানো হয়। এর পরে হয় বরণ ও সিন্দুর খেলা। এর পর হয় বিসর্জন।

শান্তিপুরের উল্লেখযোগ্য পুজোগুলির মধ্যে মহিষখাগী উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন এই পুজোতে আগে মহিষ বলি হত। অতীতে বাড়ির পুজো হলেও বর্তমানে এটি সর্বজনীন পুজোর আকার ধারণ করেছে। এর বিসর্জন দেখতে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া সাধনাকালী, বোম্বেটেকালীর পুজো বিশেষ জনপ্রিয়।

Kali Puja 2020 Diwali 2020 2020 Kali Puja Special Shantipur

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।