Advertisement
E-Paper

পুরাণ থেকে লোকাচার, ‘ভূত’ উৎসবের বিচিত্র ইতিহাস

ভূতচতুর্দশীর দিন অপদেবতারা যাতে গৃহে প্রবেশ না করেন, যে জন্য সন্ধ্যায় গৃহস্থ বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২০ ১৫:৫৬
Share
Save

‘ভূত’ শব্দটাতেই মিশে আছে এক গা-ছমছমে ভাব! কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি (অর্থাৎ অমাবস্যার আগের দিন) ‘ভূতচতুর্দশী’ নামে পরিচিত। দেশের অন্যান্য প্রান্তে সে দিন পালিত হয় নরকচতুর্দশী। বাংলায় যুগ যুগ ধরে এই দিনে দুপুরে চোদ্দশাক খাওয়া এবং সন্ধ্যায় বাড়ির চোদ্দটি জায়গায় চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানোর রীতি আছে। প্রেতপক্ষের ঠিক একমাস পরেই ভূতচতুর্দশী। একে কেন্দ্র করে রয়েছে নানা ধর্মীয় রীতি, সংস্কার, এমনকী ভয়-ভীতিও। তবে কালীপুজোর আগের দিন হওয়ায় বর্তমানে তা প্রাক কালীপুজোর এক উৎসবের চেহারা নিয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, ভূতচতুর্দশীর সঙ্গে পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চভূতের যোগ রযেছে। হিন্দু শাস্ত্রমতে পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি (মাটি), অপ্ (জল বা বরুণ), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ)— এই পঞ্চতত্ত্ব দিয়েই মানবদেহ গঠিত। আবার মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর এই পঞ্চভূতেই বিলীন হয়। ভূতচতুর্দশীতে সেই শরীর বা দেহ সংশোধন তথা সংস্কারের কথা শাস্ত্রে রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে মানবদেহ দূষিত, কমজোরি হতে পারে আবার অকেজো হয়ে পড়তে পারে। তাই এই দিনটিতে শারীরিক ক্ষয় রোধে বিশেষ ঔষধী গুণযুক্ত চোদ্দটি শাক খাওয়ার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। সেগুলি হল পলতা, বেতো, কালকাসুন্দি, সর্ষে, গুলঞ্চ, জয়ন্তী, ওল, শুষুনী, নিম, শালিঞ্চা, ঘেঁটু, হিঞ্চে। সহজ কথায়, অতীতে প্রাক-শীতে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে গড়ে ওঠে, সে জন্য চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি ছিল।

বাংলার লোকসমাজে ভূতচতুর্দশী নিয়ে নানা কাহিনি ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এ দিন অপদেবতারা যাতে গৃহে প্রবেশ না করেন, যে জন্য সন্ধ্যায় গৃহস্থ বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। মনে করা হয়, ওই দিনে পূর্বপুরুষেরা মর্ত্যে নেমে এসে দেখে যান তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছেন। কিছু আঞ্চলে তাঁদের জন্য জল, বাতাসা কিংবা মিষ্টিরও আয়োজন থাকে। ফিরে যাওয়ার সময় পথ দেখানোর জন্য বংশধরেরা প্রদীপের আলো দেখান। এমনটাই বিশ্বাস।

ভূতচতুর্দশীতে পাওয়া যায় মহাকাব্যের ছায়া। মনে করা হয়, চোদ্দো বছরের বনবাস শেষে শ্রীরামচন্দ্র এই দিনে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য গোটা অযোধ্যবাসী প্রদীপ জ্বালিয়ে অযোধ্যা নগরীকে আলোকিত করে দিয়েছিল। সেই থেকে এই প্রথা চলছে। চতুর্দশী তিথিটি আবার শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র। যেমন শিবচতুর্দশী, অনন্তচতুর্দশী ইত্যাদি। এ ছাড়াও চতুর্দশী তিথি দেবী তারার পুজোর জন্য প্রশস্ত।

আরও পড়ুন: বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী শান্তিপুরের কালীপুজো

ভূতচতুর্দশীকে কেন্দ্র করে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের অধীশ্বর দানবরাজ বলির বড়ই অহংকার ছিল দানবীর হিসাবে। এক সময় সব দেবতারা তাঁর কারণে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এমন সময় দেবগুরু বৃহস্পতি বিষ্ণুকে পরামর্শ দেন, বামন রূপে তাঁর কাছে পা রাখার জন্য মাত্র তিন পা জমি ভিক্ষা চাওয়ার জন্য। বিষ্ণু ঠিক তেমনটাই করেছিলেন। তবে অতিবিচক্ষণ বলি বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্বয়ং বিষ্ণুই তাঁর কাছে এসেছেন। তবু বিষয়টা এতটুকুও বিষ্ণুকে বুঝতে দেননি তিনি। বিষ্ণুর কথামতো তিনি রাজি হলেন শুধু মাত্র কথা রাখতে। তখন বামনরূপী বিষ্ণু একটা পা রাখলেন স্বর্গে, আর একটা পা দিলেন মর্তে। তাঁর নাভি থেকে বের হল আরও একটি পা। এই পা তিনি রাখলেন রাজা বলির মাথায়। এর পর বলি ঢুকে গেলেন পাতালে। বলি জেনে বুঝেও জমি দান করেছিলেন বলে বিষ্ণু রাজা বলির নরকাসুর রূপের পুজোর প্রবর্তন করেন মর্ত্যলোকে।

হেমন্তে ভূত উৎসবের বিচিত্র আমেজ ছড়িয়ে আছে গোটা বিশ্বে জুড়েই!

সেই থেকে ভূতচতুর্দশীর দিনে বলিদৈত্যরাজ পুজোর প্রচলন ঘটে। সেই থেকে নরকাসুর রূপে বলি রাজা মর্ত্যে আসেন পুজো নিতে। সঙ্গে থাকে তাঁর অসংখ্য অনুচর ভূত-প্রেত। তাদের দূরে রাখার জন্য প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই দিন বাড়ির বাইরে ‘যমদীপ’ও দান করা হয়। ভূতচতুর্দশীকে ‘যম চতুর্দশী’ও বলা হয়। কারণ এই দিন চোদ্দজন যমের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। এই ১৪ জন যমরাজ হলেন, ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উডুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত। ‘পদ্মপুরাণ’ অনুসারে এই তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে আর নরকদর্শন করতে হয় না।

লোকসংস্কৃতির গবেষকদের মতে, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং মালদহের কিছু জায়গায় ভূত উৎসব পালন করা হয় এই দিনে। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় এই চতুর্দশীর নাম ‘চৌরচতুর্দশী’। প্রথা অনুযায়ী, ওই দিন কিছু না কিছু চুরি করতেই হয়।

আরও পড়ুন: শ্মশানবাসিনী থেকে আদরিনী শ্যামা: কলকাতার বনেদি বাড়ির কালী পুজো

তবে শুধু আমাদের দেশেই নয়, এই ধরনের ‘ভূত উৎসব’ বিদেশেও সাড়ম্বরে পালিত হয়। আয়ারল্যান্ড, মার্কিন যুর্করাষ্ট্র, এবং কানাডায় ৩১ অক্টোবর হ্যালোয়েন পালিত হয়। তেমনই মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকার দেশেগুলিতে এই সময় পালিত হয় ‘দ্য ডে অব দ্য ডেড’। এর পাশাপাশি ২ নভেম্বর পৃথিবী জুড়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পালন করেন ‘অল সোলস্ ডে’। মার্কিন মুলুকে হ্যালোয়্রন উপলক্ষে থাকে নানা আয়োজন। বিচিত্র পোশাক, মুখোশ, উপহার, পার্টি, আলোকসজ্জার পাশাপাশি বাড়ির বাইরে শোভা পায় জ্যাক ও ল্যান্টার্ন।

তাই শুধু আমাদের দেশ নয়, হেমন্তে ভূত উৎসবের বিচিত্র আমেজ ছড়িয়ে আছে গোটা বিশ্বে জুড়েই!

Kali Puja 2020 Diwali 2020 Diwali Celebration Bhoot Chaturdashi Festival

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।