একই অঙ্গে কত রূপ! যিনি দুর্গা তিনিই কালী, আবার তিনি জগদ্ধাত্রী। তিনিই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। কখনও তিনি দশভূজা আবার কোথাও তিনি অষ্টভূজা। তবে সব রূপের মধ্যেও দেবীর এই বিন্ধ্যবাসিনী রূপের মাহাত্ম্য বিশেষ। মহাভারতের যুদ্ধ থেকে মহিষাসুর বধ তিনি বিরাজমান সর্বত্র। ভক্তরা নিজের মনের আশা পূর্ণ করতে ছুটে যান তাঁর মন্দিরে। বেনারসের একটু দূরেই তাঁর অবস্থান। আসুন জেনে নেওয়া যাক, সেই গল্প।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে দেবী বিন্ধ্যবাসিনীর প্রসঙ্গ। 'কংসকে কে বধ করবে'— সে কথা জানিয়ে দেবী চলে যান বিন্ধ্যাচলে। আর সেই থেকে অষ্টভূজারূপে বিন্ধ্যাচলেই অবস্থান করেন। ভাগবত অনুসারে তাঁর এই অষ্টভূজা রূপই যোগমায়া।
দুর্গা বিন্ধ্যাচলে জনপ্রিয় বিন্ধ্যবাসিনী নামে। পুরাণ মতে, মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে দেবতাদের তেজ একত্রিত করে মা দুর্গা নাকি আবির্ভূতা হয়েছিলেন এই পর্বত শিখরেই। মহিষাসুরকে বধ করে তিনি দেবতাদের জানান, দুর্গা নামে দশভূজারূপে তিনি চিরস্থিতা হচ্ছেন বিন্ধ্যাচলেই।
আবার দেবীপুরাণ অনুসারে, দুন্দুভি নামে এক ভয়ঙ্কর অসুরকে বধ করেছিলেন দুর্গা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে অর্জুন যে দেবীর স্তব করেছিলেন, তিনি ছিলেন বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা।
শোনা যায়, বিন্ধ্য পর্বতের এই দেবীর খ্যাতি নাকি ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর কাশ্মীর পর্যন্ত। কলহন তাঁর রাজতরঙ্গিনী-তে লিখছেন, বিন্ধ্যাচলের অরণ্যে ভ্রামরী দেবীর অধিষ্ঠান। অর্থাৎ তখন তিনি ভ্রামরী নামেও জনপ্রিয় ছিলেন।
পুরাণ বলছে, দেবরাজ ইন্দ্ৰ দুর্গাকে বিন্ধ্যপর্বতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী নামে পরিচিত। একটি ছোট পাহাড়ি টিলার উপরে দেবীর মন্দির। দুর্গা নাকি এই পাহাড়ে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন।
লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ পথ গিয়েছে পাহাড় চূড়ায়। পথের দু’পাশে দোকানপাট। পাহাড়ের কোলে বয়ে চলেছে গঙ্গা। তীর্থযাত্রীরা গঙ্গায় স্নান করে মন্দিরে পূজা দেন। ছোট্ট মন্দির। সংকীর্ণ একটি দরজা দিয়ে তার গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়।
কাছেই সীতাকুণ্ড। বনবাসের সময়ে নাকি এই পথে যেতে যেতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন সীতা। কোথাও জল না পেয়ে মাটিতে বাণ মেরে জলের ধারা বার করে আনেন লক্ষ্মণ। সুস্বাদু সেই জলধারা। পাশেই রাম-সীতা-লক্ষ্মণের মন্দির।
লোকালয় থেকে কিছু দূরে এক জনহীন পাহাড়ে অষ্টভূজা দেবীর মন্দির। টাঙ্গায় বা গাড়িতে পাহাড়ের পাদদেশে নেমে সিঁড়ি ভেঙে পাহাড় চূড়ায় মন্দিরে পৌঁছতে হয়। নামে মন্দির হলেও আসলে এটি একটি গুহা। সংকীর্ণ প্রবেশ পথের গুহার মধ্যে অধিষ্ঠান দেবী অষ্টভূজার। বলা হয়, বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা এখানে এই রূপে দেখা দিয়েছেন। গুহায় রয়েছে আরও নানা দেবদেবীর মূর্তি।
পাশেই আর একটি গুহা। তার প্রবেশপথ আরও সংকীর্ণ। মাথা নিচু করে ভেতরে যেতে হয়। এখানে দেবীর নাম মহাকালী। পাহাড়ের উপর রয়েছে ব্রহ্মকুণ্ড, অগস্ত্য কুণ্ড। এই সব গুহাগুলিকেও ঘিরে রয়েছে হরেক রকম অলৌকিক কাহিনী।
বুন্দেল রাজবংশ, যাঁদের হাতে প্রতিষ্ঠা বুন্দেলখন্ডের, তাঁদেরই প্রধান আরাধ্য দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। জনশ্রুতি বলে, বুন্দেল সর্দার হেম করণ বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর তপস্যা শুরু করেন। দীর্ঘ দিন তপস্যার পরেও দেবীর সাড়া না পেয়ে তিনি আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করেন। এই উদ্দেশ্যে নিজের শরীরে আঘাত করতেই এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে। তখন দেবী বিন্ধ্যবাসিনী তাঁকে দেখা দেন। বুন্দেল সর্দারের বংশধরদের রাজা হওয়ার বর দেন দেবী। এই 'বুন্দ' বা রক্তের ফোঁটা থেকে যেহেতু এই রাজবংশের উৎপত্তি, সে কারণে তার নাম হয় 'বুন্দেলা'।
কী ভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ট্রেনে বেনারস। সেখান থেকে ভাড়া গাড়িতে পৌঁছানো যায় বিন্ধ্যাচল।
বেনারস থেকে ৬৩ কিমি দূরত্বে দেবী বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির। গোধূলিয়া মোড় অথবা বেনারস স্টেশন থেকে সব সময়ে গাড়ি চলছে বিন্ধ্যাচলের উদ্দেশে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy