প্রতীকী চিত্র
সামাজিক ন্যায়বিচার এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের জলজ্যান্ত প্রতীক হাজরা পার্কের দুর্গাপুজো। এ বার ৮২তম বছরে তারা উদ্যাপন করছে থিম ‘শুদ্ধি’র মাধ্যমে, যার অর্থ শুদ্ধিকরণ। এর মূলে রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, যা একটি ছোট সমাবেশ থেকে শুরু করে শহর জুড়ে ভক্তদের আকৃষ্ট করে একটি বিশাল অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বরাবরই এই পুজো সাম্য ও মানবাধিকারের লড়াইয়ে অগ্রভাগে থেকেছে। মূলত দলিত সম্প্রদায়ের সংগঠিত এই পুজোটি একজোট হয়ে কাজের শক্তিকে উদযাপন করে। কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা এই পুজোর গভীর ভূমিকা ছিল ১৯৪০-এর দশকের সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম অতিবাহিত করার নেপথ্যে। হাজরা পার্কের দুর্গাপুজো তাই শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু।
৮২ বছর আগে পথচলা শুরুর সময়ে হাজরা পার্কের এই পুজো এমন কিছু করার সাহস করেছিল, যা তখন অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। তৎকালীন কলকাতায় প্রচলিত বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করার একটি উপায় হিসেবে পুজোকে কল্পনা করেছিলেন উদ্যোক্তারা।
৪০-এর দশকে মেথরদের সমাজে কোনও জায়গা ছিল না। উৎসবে যোগদানের কোনও রকম অনুমতিও ছিল না। দলিত/মেথরদের তখম অপবিত্র বলে মনে করা হত। তাই দুর্গাপুজো মণ্ডপগুলিতে দেবীর কাছে পুজো বা প্রার্থনার জন্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল তাঁদের উপরে। মা দুর্গাকে কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপে নিয়ে আসার সময়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই তাঁরা প্রণাম করতেন। বিসর্জনের সময়ে দলিতরা গঙ্গার ধারে দাঁড়াতেন, দূর থেকে সংযত হয়ে প্রণাম জানাতেন। মায়ের কাছে দুঃখ করে বলতেন, এমন করে সমাজ কেন বৈষম্য করে।
১৯৪০ সালে মেথর/দলিতদের জন্য একটি দুর্গাপূজা আয়োজনের উদ্দেশ্যে একটি ছোট প্রতিমা নিয়ে এসেছিলেন ডিপোর কর্মী এক ব্যক্তি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এটি সত্যিই ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। দুর্ভাগ্যবশত এই ঘটনাকে উচ্চ বর্ণের মানুষদের তৈরি করা রীতিনীতি লঙ্ঘন হিসাবে দেখা হয়েছিল এবং রক্ষণশীলদের হুমকির সম্মুখীন সেই ব্যক্তি হয়েছিলেন। পরে তিনি ডিপো থেকে পালিয়ে যান। গোটা ঘটনাটি ডিপোর টিম কিপার তৎকালীন কেএমসি-র অফিসারকে জানালে উচ্চবর্ণের কর্মচারী এবং অফিসাররা একজোট হয়ে কেএমসির দলিত কর্মচারীদের জন্য দুর্গাপুজোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রথম পুজোটি সাধারণ ভাবে উদযাপিত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে এটি কদমতলায় আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৪৫ সাল থেকে পুজোটি হাজরা পার্কে, বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। শহরের দলিতদের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে সত্যিই এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
এ বারের ভাবনা ‘শুদ্ধি’র তাই ঐতিহাসিক তাৎপর্যও রয়েছে। সমাজের অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমতার জন্য লড়াই অব্যাহত-- সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যাঁরা আরও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের জন্য চেষ্টা করছেন, তাঁদের জন্য এই পুজো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করুক-- এটাই উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য।
হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সায়নদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের পুজো শুধু বিশ্বাসের উদ্যাপন নয়, এটা আমাদের সম্মিলিত শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতার উদযাপন। এই পুজো মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা একত্রিত হতে পারি। এ বছরের থিম বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিবৃতি এবং আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে আমরা যে অগ্রগতি করেছি, তার একটি অনুস্মারক।”
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy