প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

কী অদ্ভুত আচার! ভাইফোঁটায় যম ও তাঁর সহকারী চিত্রগুপ্তের পুজো করে বাংলা, কোথায় জানেন?

ভাইফোঁটায় বাংলার নানা জায়গায় যমের পুজো হয়। যমের অরুচি হয়ে থাকুক ভাই-দাদারা, এই কামনা থেকে হয়তো যমের আরাধনার এত ঘটা।

সৌভিক রায়

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:২২
সংগৃহীত চিত্র।

সংগৃহীত চিত্র।

কোনও মৃতদেহ যখন চোখের সামনে দিয়ে যায়, তখন আপনা থেকেই হাত কপালে উঠে আসে। প্রার্থনা করা হয়, রওনা হয়ে যাওয়া মানুষটির আত্ম যেন শান্তি পায়। বলা হয়, ‘ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু’, এর অর্থ যিনি মারা গেলেন তিনি দিব্যলোকে গমন করুন। যমরাজ আত্মাকে এক লোক থেকে আর এক লোকে পৌঁছে দেওয়ার কারিগর। ভাইফোঁটায় যমের দুয়ারে কাঁটা ফেললেও বাংলার কয়েক জায়গায় ধূপ-ধুনো, ফুল, ফল দিয়ে যমের পুজোও হয়। বাংলা বরাবর চেয়ে এসেছে যমের কাছে তাদের ঘরের ছেলেরা যেন তিতা হয়ে থাকে। যমের অরুচি হয়ে থাকুক ভাই-দাদারা। সে কামনা থেকে হয়তো যমের আরাধনার এত ঘটা। যমের আরাধনা হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে। আবার কেউ কেউ এই দ্বিতীয় তিথিটিকে যম দ্বিতীয়াও বলেন।

কার্তিক মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার লোয়াদা বকুলতলা তরুণ সঙ্ঘ যমরাজের পুজোর আয়োজন করে। প্রায় বছর সত্তর যাবৎ এই পুজো হচ্ছে। কাঁসাই নদী ঘেঁষা লোয়াদা ছিল সমৃদ্ধ গ্রাম। কলেরার প্রকোপে লোয়াদা উজাড় হতে বসেছিল। তার পর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন গ্রামে যমের পুজো হয়। গ্রাম রক্ষা পায়। আজও সেই প্রথা মানা হয়। তবে এখন ভাইফোঁটার দিন যমের পুজো হয়।

ভাইফোঁটার দিন যাদবপুর স্টেশন রোডেও ধুমধাম করে হয় যমরাজের পুজো। সে পুজোর বয়স প্রায় বছর দশ-পনেরো। পশ্চিম বর্ধমানের তিলাবনি গ্রামেও যমরাজের আবার হয়। সর্বত্র যমের ভয়ঙ্কর মূর্তি পূজিত হয়।

আবার বঙ্গে সৌম্যকান্তি যমেরও পুজো হয়। এক দিন, দু’দিনের পুজো নয়! খাস কলকাতায় যমের স্থায়ী মন্দির রয়েছে। ১৯৫২ নাগাদ পরেশনাথ মুখোপাধ্যায় বাগবাজারে গিরিশ ঘোষের পাড়ায় এক মন্দিরে যমরাজের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। এই মন্দিরে কালো মোষের পিঠে যমের বসা মূর্তি বিরাজমান। যমরাজের গায়ের রং সবুজ। সৌম্যকান্তি চেহারা। হাতে রুপোর দণ্ড। পরনে ধুতি। ভাইফোঁটার আগে হয় বিশেষ পুজো। ভাইফোঁটার দিন ভিড় উপচে পড়ে। প্রতি বুধবার যমের বিশেষ পুজোও হয় মন্দিরে।

ভাইফোঁটার দিন যমের কেরানী চিত্রগুপ্তেরও পুজো হয়। হুগলির আরামবাগের বাতানলের কায়স্থপাড়ায় পুজো পান যমরাজের হিসাবরক্ষক চিত্রগুপ্ত। পদ্মাসনে বসা চিত্রগুপ্তের চার হাতের মধ্যে এক হাতে থাকে গদা, অন্য হাতে তরোয়াল। বাকি দুই হাতে কলম ও দোয়াত। গায়ের রং সবুজ। আয়োজক পরিবারের মহিলারা চিত্রগুপ্তকে ফোঁটা দেন। তার পর নিজেদের ভাইদের ফোঁটা দেন। বহু বছর আগে গোটা বাংলায় ভাইফোঁটার দিন আড়ম্বরের সঙ্গে চিত্রগুপ্তের পুজো হত। কায়স্থ সম্প্রদায়ের মানুষ চিত্রগুপ্ত পুজোর আয়োজন করতেন। এখন আর সারা রাজ্যে এই পুজোর চল নেই। তবে বাতানল গ্রামে রীতিতে ছেদ পড়েনি।

ভাইফোঁটার দিনে চিত্রগুপ্তের পুজোর মূল উদ্যোক্তা ছিল বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা। ১৯০১ সালে বাংলায় জনগণনা হল। ব্রিটিশ আধিকারিক রিজলির রিপোর্টে দেখা গেল, বঙ্গে কায়স্থদের সামাজিক অবস্থান ছয় নম্বরে। সেই বছরই জন্ম হল ‘বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা’র। কৌলীন্য আদায়ের তাগিদে তাঁরা শুরু করলেন চিত্রগুপ্তের পুজো। ‘কায়স্থ পুরাণ’-র লেখক শশীভূষণ নন্দীবর্মা ছিলেন এর অন্যতম হোতা। ব্রহ্মার কায়া থেকে চিত্রগুপ্তের উৎপত্তি, তাঁর বংশধরেরা কায়স্থ নামে পরিচিত, কায়স্থ সভা উঠে পড়ে লাগল এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায়। শোভাবাজারের দেব বাড়িতে ১৯৫১ সালে বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে চিত্রগুপ্তের পুজো করার প্রস্তাব উঠল।

কায়স্থ সভার মুখপত্র থেকে জানা যায়, কালীঘাটের মাখনলাল ভাগবতভূষণের বাড়িতে ভাইফোঁটার দিন চিত্রগুপ্তের পুজো হত। কলকাতায় কোন কোন বাড়িতে এবং মফস্‌সলে কোথায় কোথায় চিত্রগুপ্তের পুজো হয়েছে, তার হিসেব ছিল পত্রিকায়। রাজশাহী কায়স্থ সমিতি প্রতি বছর ভাইফোঁটার দিন চিত্রগুপ্ত পুজোর আয়োজন করত। আরামবাগ, দিনাজপুরেও প্রতি বছর ফুল, জল পেতেন চিত্রগুপ্ত। আরামবাগে এখনও পান।

আবহমানকাল থেকে ভাই-বোনের সম্পর্ককে বেঁধে রেখেছে ভাইফোঁটার মতো উৎসব। ফোঁটা দিতে দিতে দীর্ঘায়ু কামনা করেন বাংলার ভগিনীরা। যম মৃত্যুর দেবতা, তাঁর দূত আত্মকে নিয়ে যায় বিচারসভায়। চিত্রগুপ্তের হিসাবের খাতা দেখে বিচার হয়। যম ও চিত্রগুপ্তের পুজো করে তুষ্ট করতে পারলেই প্রাণ রক্ষা হবে। দীর্ঘায়ু হবেন পরিবারের মানুষেরা, এই বিশ্বাস থেকে লোকায়ত বঙ্গে যম ও চিত্রগুপ্তের পুজো হয়।

ভাইফোঁটার ছড়াতেও একই কামনা থাকে। তাই ভাই-দাদাদের দীর্ঘায়ু কামনার দৌলতে ভাইফোঁটা তিথি আর যম ও চিত্রগুপ্তের পুজোর দিন মিলে গিয়েছে বঙ্গে।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

Bhai dooj Kali Puja 2025
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy