লোকসানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতে হলদিয়া বন্দরের হাতিয়ার এ বার মাসুল ছাড়।
ব্যবসা ফেরাতে অবশেষে হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ মাসুলের উপর আকর্ষণীয় ছাড়কেই বিপণনের নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এই বিপণন প্যাকেজ নিয়ে ইতিমধ্যেই সেল ও টাটা স্টিলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তাঁরা। এই দুই সংস্থা হলদিয়া বন্দরের অন্যতম বড় খদ্দের।
বছর চারেক ধরেই রাজনৈতিক কারণে হলদিয়া বন্দরের দুই ও আট নম্বর বার্থের পণ্য খালাস করা নিয়ে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা চলছে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক দাদাগিরির কারণে এই বার্থ দু’টির দায়িত্বে থাকা সংস্থা এবিজি রাজ্য থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, সেই একই রাজনৈতিক মদতে কয়েকটি পণ্য খালাসকারী সংস্থা বন্দর কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা না-করে ব্যবসা চালাচ্ছিল। বেআইনি ভাবে চড়া হারে মাসুল আদায় করছিল তারা। এবং এর কানাকড়িও বন্দরের কোষাগারে আসেনি। অথচ এই দু’টি বার্থই সবচেয়ে লাভজনক। সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, এবিজি বিদায়ের পর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ লক্ষ টাকা লোকসান করছে হলদিয়া বন্দর।
জাহাজ থেকে ট্রাক বা ট্রেনে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার গোটা প্রক্রিয়াটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। জাহাজ থেকে মাল জেটি বা বার্থে নামানো হয়। একে বলে ‘স্টিভেডরিং’। বার্থ থেকে পণ্য সরানো বা ‘শোর অপারেশন’ করে অন্য সংস্থা। হলদিয়া বন্দরে জাহাজ থেকে দুই ও আট নম্বর বার্থে পণ্য নামানোর কাজ পেয়েছে ওড়িশা স্টিভেডর ও বোথরা গোষ্ঠী। বার্থ থেকে পণ্য খালাস করার বরাত পেয়েছে কলকাতার ই সি বোস অ্যান্ড কোম্পানি।
বন্দর সূত্রের খবর, ওড়িশা স্টিভেডর ও বোথরা গোষ্ঠীকে টন প্রতি ৭৪ টাকা দেবে বন্দর। এবং ই সি বোসকে দেওয়া হবে টন প্রতি প্রায় ৬৪ টাকা। সব মিলিয়ে এক টন পণ্য খালাসের জন্য হলদিয়া বন্দরের খরচ দাঁড়াচ্ছে ১৩৮ টাকা। ট্যারিফ অথরিটি অব মেজর পোর্টস আইন অনুযায়ী আমদানিকারী সংস্থার থেকে টন প্রতি ২৮০ টাকা পর্যন্ত মাসুল নিতে পারবে হলদিয়া বন্দর। অর্থাৎ পণ্য খালাসকারী সংস্থাদের পাওনা চুকিয়েও বন্দরের হাতে থাকবে আরও ১৪০ টাকার মতো। বন্দর সূত্রের খবর, এই বাড়তি লাভের টাকাই হবে বিপণনের নতুন তুরুপের তাস। লাভের পুরো টাকা ঘরে না-তুলে তার একাংশ মাসুলের উপর ছাড় হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে বন্দর। পণ্যের পরিমাণের উপর নির্ভর করবে ছাড়ের অঙ্ক। এই অঙ্ক কষার কাজ শুরুও করে দিয়েছেন হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বেআইনি ভাবে মাসুল আদায়ের জেরে বর্তমানে টন প্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা মাসুল হিসেবে গুনতে হয় আমদানিকারীদের। নতুন ব্যবস্থায় শুধু আমদানিকারী সংস্থারই লাভ হবে না, বন্দরের মাসুল প্যাকেজে লাভবান হবে পণ্য খালাসকারী সংস্থাও। ই সি বোস কোম্পানির প্রধান পার্থসাধন বোসের দাবি, ৬৪ টাকার মতো দর দিয়েও ব্যবসায় লাভ করা সম্ভব। দু’টি বার্থ মিলিয়ে কমপক্ষে ৪০ হাজার টন পণ্য প্রতিদিন খালাস হবে। এই নিশ্চিত ব্যবসার উপরে রয়েছে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা। প্যাকেজের টানে বাড়তে পারে আমদানি সংস্থার পণ্যের পরিমাণ। বন্দর সূত্রের খবর, সেল ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, মাসুল আকর্ষণীয় হলে আরও ৩৫ লক্ষ টন পণ্য হলদিয়া বন্দরে আনবে তারা।
একে হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা বড় জাহাজ আসার পক্ষে উপযুক্ত নয়। ফলে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে করে মাল নিয়ে আসা বা ট্রান্সলোডিং-এর জন্যও টন প্রতি ৬০০ টাকা খরচ হয়। তার উপরে চড়া মাসুলের চাপ। ফলে এই বন্দর ছেড়ে পারাদীপ ও ধামরায় ভিড় জমাচ্ছে আমদানিকারী সংস্থাগুলি।
মূলত কয়লা ও আকরিক লোহার মতো ভারী পণ্য খালাসের জন্যই এই দু’টি বার্থ ব্যবহৃত হয়। এখন অবশ্য আকরিক লোহার আমদানি প্রায় নেই। ম্যাঙ্গানিজ ও চুনাপাথর আসে সেখানে। সবচেয়ে লাভজনক দু’টি বার্থের এই দুরবস্থার কারণে হলদিয়া বন্দরের আর্থিক অবস্থা বেহাল।
পরিস্থিতি বদলাতে মরিয়া হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় বেসরকারি সংস্থার থেকে দরপত্র চেয়েছে। কিন্তু কিছু সংস্থা যোগসাজশ করে প্রতিবারই টেন্ডার প্রক্রিয়া ভেস্তে দিয়েছে কখনও কম দর দিয়ে, কখনও আইনি জট তৈরি করে। আদালতে জমা দেওয়া আবেদনেও এই সমস্যার কথা বলেছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত এপ্রিলে তিনটি সংস্থাকে দরপত্র দেওয়ার জন্য যোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। দরপত্র জমা দেয় ই সি বোস অ্যান্ড কোম্পানি, ওড়িশা ম্যাঙ্গানিজ অ্যান্ড মিনারেলস ও আইআরসি ন্যাচারাল রিসোর্সেস। এর মধ্যে প্রতি টন ৬৩.৬৩ টাকা দর দিয়ে বরাত জেতে ই সি বোস।
পঞ্চম বারের এই প্রচেষ্টাও ভেস্তে দিতে মামলা করেছিল গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সংস্থা। তবে তা ধোপে টেকেনি। উল্টে ভুয়ো নথিপত্র জমা দেওয়ায় সংস্থাটির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy