টিম কুক। — এএফপি
দেবকীর অষ্টম সন্তানকে নিয়ে কংসের উদ্বেগের শেষ ছিল না। আর অ্যাপলের ‘৮ নম্বর’ ফোন নিয়ে উৎসাহের অন্ত নেই গুণমুগ্ধদের। এতটাই যে, ‘আই ফোন ৭’ থেকে পর্দা ওঠার রাতেই শুরু হয়ে গেল ‘আই ফোন ৮’-এর জন্য প্রহর গোনা! স্টিভ জোবসের হাতে গড়া অ্যাপলের ইতিহাসে যা সম্ভবত আগে ঘটেনি।
কারও টুইট, ‘‘সামনের বারই ১০ বছর পূর্তি আই ফোনের। নিশ্চিত থাকুন, অপেক্ষা করছে বড় চমক। অপেক্ষায় রইলাম।’’ আবার কেউ লিখছেন, ‘‘আই ফোন-৭ বাজারে এনে নিছকই কিছুটা সময় কিনছে অ্যাপল। অস্তিনে টেক্কা লুকোনো রইল ২০১৭ সালের জন্যই।’’
উপরের টুইট কিংবা পোস্ট যদি অ্যাপল-পাগলদের বয়ান হয়, তবে কিছুটা কর্কশ বিশেষজ্ঞদের গলা। তাঁদের মতে, পরের বছর সত্যিই উদ্ভাবনী ও নজরকাড়া কিছু করতে না-পারলে অনেক বেশি কড়া টক্করের মুখোমুখি হবে অ্যাপল। কারণ, বিপণন আর নাটকীয়তার মিশেলে কর্ণধার টিম কুক আই ফোন ৭-কে যতই সেরা বা অভিনব তকমা দিন, অ্যাপলের উদ্ভাবনী ছাপ সেখানে কোথায়? চোখটানা ডিজাইন, সাঁতার কাটার উপযুক্ত স্মার্ট ওয়াচ, তারহীন ইয়ারফোন, উন্নততর ক্যামেরা বিক্রি বাড়ানোর হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু বাজারকে ধাক্কা দেওয়ার স্পর্ধা সেখানে কোথায়? কোথায় দুনিয়াকে চমকে দেওয়া নতুন গ্যাজেট? কিংবা নিদেনপক্ষে ‘আই ফোন ৫’-এর মতো পৃথিবী জুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া নকশা? বরাবর অ্যাপলের জন্য যে-মাপকাঠি বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন জোবস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দুনিয়ায় আই ফোনের বিক্রি লাফিয়ে বাড়ার সম্ভাবনা কম। সম্প্রতি তা কমেছে চিনেও। ১৩ বছরে প্রথম বার কোনও ত্রৈমাসিকে কমেছে আয়। টানা দুই ত্রৈমাসিকে পড়েছে আই ফোনের বিক্রি। ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে স্যামসাং, এলজি-র মতো প্রতিদ্বন্দ্বী। সঙ্গে রয়েছে ইউরোপে ১,৪৫০ কোটি ডলার বকেয়া করের বোঝা। এ অবস্থায় বাজারে দখল বজায় রাখতে আগামী বছর অ্যাপলের তুরুপের তাস আই ফোন ৮ হয় কি না, সে দিকেই নজর সকলের।
ব্যবসার অঙ্ক বা ব্র্যান্ডের দাপটের নিক্তিতে অ্যাপলের ওজন কমেনি কখনও। বাজারে সংস্থার মোট শেয়ার-মূল্য ৫৮ হাজার কোটি ডলার। হাতে নগদই ২০ হাজার কোটি। দুনিয়ায় তারাই সব থেকে বেশি হারে মুনাফা করা বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য সংস্থা। অ্যাপল মিউজিক থেকে গান কিনছেন ১.৭ কোটি জন। সংস্থার ঘর থেকে শুধু অ্যাপ ডাউনলোডের সংখ্যাই ১৪ হাজার কোটি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু সংখ্যা কখনও বাকিদের থেকে অ্যাপলকে আলাদা করেনি। বরং বরাবর তা সম্ভ্রম কুড়িয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে উদ্ভাবন আর প্রযুক্তিতে কয়েক কদম এগিয়ে থাকার জন্য। অনেকের আশঙ্কা, হালে সেই দূরত্ব কিছুটা হলেও কমছে। ফি বছর অ্যাপলের ঘোষণার মঞ্চে হাততালির ঝড় উঠছে ঠিকই। কিন্তু জোবসের জাদু যেন কিছুটা উধাও।
নইলে এত ঘটা করে আই ফোন-৭ আনার ঘোষণার দিনেও কেন এমন ঝিম মেরে থাকবে অ্যাপলের শেয়ার? কেন বলার আগেই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাবে নতুন ফোনের প্রায় যাবতীয় ‘চমক’? সংবাদমাধ্যমের প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও যাকে গোপনীয়তার নিশ্ছিদ্র মোড়কে পুরে রাখতেন স্টিভ জোবস।
বাজার জানে, জোবসের জুতো পায়ে গলানো শক্ত। তা তিনি তাঁর হাতে বাছাই উত্তরসূরি টিম কুক হলেও। তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার মতে, কুক দক্ষ নেতা। নইলে জোবস চলে যাওয়ার পরে অ্যাপলের হাল ধরা মুখের কথা নয়। ধুরন্ধর ব্যবসায়ীও। যার জোরে আই ফোন-৭ বিক্রিতেও হয়তো অসুবিধা হবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার খ্যাপাটে জিনিয়াসপনা অন্তত এখনও তাঁর মধ্যে গরহাজির। অন্য সংস্থা হলে হয়তো তাতে তেমন সমস্যাও হত না। কিন্তু অ্যাপলের মুশকিল হল, জোবসের জিনিয়াসই তার ‘ইউএসপি’। দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেওয়া উদ্ভাবনই তার আসল ব্র্যান্ড। বাকিদের কয়েক মাইল পিছনে ফেলে রাখাতেই তার আসল মস্তানি।
তাই আই ফোনের ১০ বছর পূর্তির দিকে চোখ সকলের। অপেক্ষা ‘শীত ঘুম’ শেষে বড় বিস্ফোরণের। তবে কি ২০১৭ সালেই চালকহীন গাড়ি আনবে অ্যাপল? না কি তাক লাগাবে কৃত্রিম মেধার প্রয়োগে? আর এই সূত্র ধরে অপেক্ষা ‘আই ফোন-৮’-এরও। কংস বধ করে পৃথিবী রক্ষা করেছিলেন কৃষ্ণ। প্রতিযোগীদের যুঝে অ্যাপলের বাজার-দখল বাড়াতে আই ফোন-৮ পারবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা এখন এক বছরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy