নিখরচার (ফ্রি) পরিষেবা শেষ হচ্ছে ৩১ মার্চ। কিন্তু তার পরের দিন (১ এপ্রিল) থেকেই মাসুলের ‘দঙ্গল’ শুরুর দামামা বাজিয়ে দিল রিলায়্যান্স জিও। উস্কে দিল এ দেশের টেলি পরিষেবা বাজারে ফের এক প্রস্ত উথাল-পাথালের সম্ভাবনাও। যার মধ্যে ‘ব্র্যান্ড বিমল’-এর হাত ধরে কাপড় ব্যবসায় ধীরুভাই অম্বানীর ‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’ আনার ছায়া দেখছেন অনেকে।
মঙ্গলবার রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর কর্ণধার মুকেশ অম্বানীর দাবি, আগামী অর্থবর্ষের প্রথম দিন থেকে জিও-র পরিষেবায় মাসুল গুনতে হবে ঠিকই। কিন্তু তখনও দেশে সব থেকে সস্তায় সবচেয়ে দ্রুত গতির (৪জি) নেট পরিষেবা দেবেন তাঁরা। যে কোনও একটি অঙ্কে বাজারে অন্য সংস্থা যত ‘ডেটা’ দেয়, জিও না কি দেবে তার তুলনায় ২০% বেশি।
তা ছাড়া, যাঁরা ইতিমধ্যে জিও-র সংযোগ নিয়েছেন কিংবা ৩১ মার্চের মধ্যে নেবেন, একগুচ্ছ সুবিধা তোলা থাকবে তাঁদের জন্য। ৯৯ টাকায় সংযোগ আর মাসে ৩০৩ টাকার রিচার্জে তাঁরা পাবেন দিনে ১ জিবি করে ডেটা। তার জন্য শুধু সদস্য হতে হবে ‘জিও-প্রাইম’ প্রকল্পে। তার উপর, দেশের যে কোনও জায়গায় মোবাইলে কথা বলতে কখনও কারও টাকা লাগবে না বলে সংস্থার দাবি।
সংশ্লিষ্ট শিল্পমহল অবশ্য মনে করে, ১৯ থেকে ৪,৯৯৯ টাকার যে ১০টি প্রকল্প মুকেশ আগে ঘোষণা করেছেন, তার অনেকগুলিই অন্যান্য সংস্থার চালু প্রকল্পের থেকে খুব আলাদা নয়। একেবারে ‘ফ্রি’ নয় কথা বলা। সস্তা হলেও তার দাম আসলে ধরা আছে জিও-র প্যাকেজের মধ্যে। কিন্তু পুরো বিষয়টি বিপণনের এমন নিখুঁত সুতোয় মুকেশ গেঁথেছেন, যে তা আছড়ে পড়ছে সুনামির মতো।
আরও পড়ুন: স্মৃতির পাতায় ঠাঁই পেতে পারে মারি, গ্লুকোজ, মিল্ক বিস্কুট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিও-র ‘ফ্রি’ পরিষেবার ধাক্কায় লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছে আইডিয়া-কে। এখন ভোডাফোনের সঙ্গে গাঁটছড়ার কথা চলছে তাদের। মুনাফা কম-বেশি ধাক্কা খেয়েছে প্রায় সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বী টেলি পরিষেবা সংস্থার। এই পরিস্থিতিতে তারা যে মাসুল চালু করছে, তাতেই কার্যত স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে টেলি পরিষেবা সংস্থাগুলির সংগঠন সিওএআই। একই সঙ্গে সংস্থাগুলির আশা, এক বার পরিষেবায় টাকা গুনতে হলেই জিও নিয়ে এই হিড়িক আর থাকবে না।
এক টেলি পরিষেবা সংস্থার কর্তা বলছিলেন, ‘‘জিও মাসে ৩০৩ টাকায় ঢালাও ডেটা দেওয়ার কথা বলছে। অত টাকার রিচার্জ এ দেশে করেন ক’জন? এখানে গড় রিচার্জের অঙ্ক তো ১৮০ টাকা মতো।’’ আর এক সংস্থার কর্তার কথায়, ‘‘অন্য সংস্থার সংযোগ ছেড়ে জিও-র সিম নেওয়ার সংখ্যা কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় সিম হিসেবে। নিখরচার পরিষেবার সুবিধা নিতে। ফলে টাকা নেওয়া শুরু হলে, সেই আকর্ষণ আর থাকবে না।’’ তা ছাড়া, টাকা গুনে পরিষেবা নিতে হলেই গ্রাহকরা তার গুণমান খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করবে বলে তাঁদের আশা।
প্রতিদ্বন্দ্বীরা যতই প্রশ্ন তুলুক, রিলায়্যান্সের ব্যবসা কৌশলে জিও-র গুরুত্ব যে এখন কতখানি, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল গত ১ সেপ্টেম্বর গোষ্ঠীর বার্ষিক সাধারণ সভাতেই। ওই দিন দেশের ধনীতম শিল্পপতির বক্তৃতায় প্রথম দশ পাতা জুড়ে শুধুই ছিল জিও-র পরিকল্পনা! মুকেশ বলেছিলেন, ভারতে টেলি পরিষেবার ভোল বদলাতে ‘ডেটাগিরি’র রাস্তায় হাঁটবেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ডেটাই এখন রিলায়্যান্সের নতুন তেল।’’ গ্রাহকের সংখ্যা যে খুব দ্রুত ১০ কোটিতে নিয়ে যেতে চান, সে কথাও সে দিনই জানিয়েছিলেন তিনি।
মঙ্গলবার সেই মাইলফলক ছোঁয়ার কথা ফলাও করে ঘোষণা করেছেন মুকেশ। বলেছেন, ‘‘মাত্র ১৭০ দিনে গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে জিও-র। মানে প্রতি সেকেন্ডে সংযোগ নিয়েছেন ৭ জন!’’ তাঁর দাবি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে শুরু করে বিশ্বের আর কোনও নতুন ব্যবসা শুরু করা সংস্থায় (স্টার্ট-আপ) এমনটা ঘটেনি।
অবশ্য এমন ঝড় যে আসছে, বেশ কিছু দিন ধরেই তার আঁচ পাচ্ছিল টেলি পরিষেবা শিল্প। মুকেশের প্রথম ঘোষণাতেও ইঙ্গিত মিলেছিল ‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’-এর। যা দেখে বারবার তার মধ্যে আগমার্কা অম্বানী-ছাপ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। বলছেন,
এক সময় পেল্লাই স্বপ্ন, বড় লগ্নি আর নিখুঁত বিপণনের মন্ত্রে এ দেশে পলিয়েস্টার সুতো ও কাপড়ের ব্যবসার চালু ধ্যান-ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই অম্বানী। তৈরি হয়েছিল ব্র্যান্ড ‘বিমল’। লোকের মুখে-মুখে ফিরত তার বিজ্ঞাপনী স্লোগান— ‘ওনলি বিমল’। এখন একই ভাবে ইন্টারনেট মারফত তথ্য (ডেটা) আদানপ্রদানের বিপুল বাজারে দাদাগিরি (ডেটাগিরি) কায়েমকে পাখির চোখ করছে মুকেশের সংস্থা রিলায়্যান্স জিও।
এ দিন পরিসংখ্যান দিয়ে রিলায়্যান্স কর্ণধার বলেছেন, কী ভাবে তাঁদের হাত ধরে ডেটার ব্যবহার হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে এ দেশে। বাড়ছে নেটে ভিডিও দেখার চল। তাঁর কথায়, ‘‘আনলিমিটেড মজা কন্টিনিউ হয়েঙ্গা।’’ অর্থাৎ, জারি থাকবে দেদার ডেটা ব্যবহারের আনন্দ।
কিন্তু কম মাসুলের পরিষেবা দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে যেতে পারবে জিও? তাতে সম্ভব হবে মুনাফার মুখ দেখা? বাজারের বড় অংশ কব্জায় এলেও দর একই থাকবে তো? মাসুলের কুস্তির ধকল সামলে কতটাই বা মজায় থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বীরা? ফ্রি পরিষেবা নিয়ে যাদের সঙ্গে জিও-র তেতো লড়াই আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বাজারে অপেক্ষা এখন এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy