Advertisement
১৯ মে ২০২৪

লগ্নি বাছাই

ডাক্তারি না ই়ঞ্জিনিয়ারিং? পাহাড় না কি সমুদ্র? ধন্দে ফেলে দেওয়া এমন সব চিরকালীন প্রশ্নের মতোই দ্বন্দ্ব হাজির সঞ্চয়ের দুনিয়াতেও। ইকুইটি না কি ডেট ফান্ড? সোনা না গোল্ড ইটিএফ? আসুন পরখ করিজীবনের পথ চলতে গিয়ে অনেক সময়েই ঘোর দ্বন্দ্বে পড়ি আমরা। ঠিক কোন পথ ধরা উচিত, বেশ বেগ পেতে হয় তা ঠাওর করার জন্য। ডাক্তারি না ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স না কি কমার্স, পাহাড় না সমুদ্র, চিকিৎসা কলকাতায় না কি ভেলোরে— এমন অজস্র প্রশ্নের মুখে পড়ে দশা হয় প্রায় চুল ছেঁড়ার। সঠিক রাস্তা বাছাই আরও কঠিন হয় যদি দু’টি বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না-থাকে। লগ্নির দুনিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়।

অমিতাভ গুহ সরকার

অমিতাভ গুহ সরকার

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০২:৫৪
Share: Save:

জীবনের পথ চলতে গিয়ে অনেক সময়েই ঘোর দ্বন্দ্বে পড়ি আমরা। ঠিক কোন পথ ধরা উচিত, বেশ বেগ পেতে হয় তা ঠাওর করার জন্য। ডাক্তারি না ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স না কি কমার্স, পাহাড় না সমুদ্র, চিকিৎসা কলকাতায় না কি ভেলোরে— এমন অজস্র প্রশ্নের মুখে পড়ে দশা হয় প্রায় চুল ছেঁড়ার। সঠিক রাস্তা বাছাই আরও কঠিন হয় যদি দু’টি বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না-থাকে। লগ্নির দুনিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়।

অর্থকড়ি বা সঞ্চয়ের ব্যাপারেও এই ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মুখে হামেশাই পড়তে হয় আমাদের। সুদ, লগ্নির সুরক্ষা, কর ইত্যাদির নিরিখে অনেক সময়েই সমস্যায় পড়তে হয় একাধিক প্রকল্পের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে।

আজ আমাদের লক্ষ্য তাই বিনিয়োগের দুনিয়ায় এমন দু’টি করে বিষয় একযোগে বেছে নিয়ে তাদের পর্যালোচনা করা। এমন দু’টি বিষয়, যারা এমনিতে বিভিন্ন দিক থেকে বেশ কাছাকাছি। অথচ যাদের মধ্যে একটিকে বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয় আমাদের।

দু’য়ের সম্পর্কেই অন্তত মূল বিষয়টুকু জানা থাকলে যদি সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়, তবে সেইটুকু কষ্ট করতে আর আপত্তি কী?

সরকারি ব্যাঙ্ক না বেসরকারি?

আমাদের অনেকেরই ধারণা, বেসরকারি ব্যাঙ্কে টাকা রাখা আদৌ নিরাপদ নয়। কারণ, সরকারি ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের তহবিলের সুরক্ষা অনেক বেশি। সেখানে রাখা টাকায় সরকারের নিশ্চয়তার হাত আছে। আর উল্টো দিকে, বেসরকারি ব্যাঙ্কে তহবিল তৈরি করলে, যে-কোনও সময়ে তা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি না কি থাকবেই। এই কারণে অনেক সময়ে সুদের হার একটু কম হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে পছন্দ করি আমরা। কষ্টের সঞ্চয় কোথায় রাখবেন, তা একেবারেই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই দোটানায় যাতে অযথা ভুগতে না-হয়, সে জন্য নীচের কথাগুলি মাথায় রাখা জরুরি—

• গত দু’দশকে বেসরকারি ব্যাঙ্কের জনপ্রিয়তা বেড়েছে দ্রুতগতিতে। মূল কারণ: আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত পরিষেবা, সুদের ভাল হার, ঝকঝকে অফিস, কর্মীদের ব্যবহার ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ, সাধারণত ন্যূনতম জমা অনেকটাই বেশি রাখতে হয় বেসরকারি ব্যাঙ্কে।

• প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপস্থিতি, গ্রাহক সংখ্যা ইত্যাদির বিচারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে চট করে ধরা শক্ত। কিন্তু তেমনই এ কথাও অস্বীকার করার জো নেই যে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির ব্যবসা বৃদ্ধির গতি অনেক সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে ছাপিয়ে যায়। এই ব্যবসা এবং লাভের বৃদ্ধির দিক থেকে প্রথম সারির কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে অধিকাংশ সরকারি ব্যাঙ্ককে।

মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রথম পাঁচ ব্যাঙ্কের মধ্যে তিনটিই কিন্তু বেসরকারি। এগুলি হল— আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক এবং অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক। পাশাপাশি, দ্রুত বেড়ে উঠছে ইন্ডাসইন্ড, ইয়েস ব্যাঙ্ক, কোটাক মহীন্দ্রা ব্যাঙ্কও।

• সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা এখন পাহাড়প্রমাণ। সময়ে শোধ না-হওয়া ধারের জন্য হিসেবের খাতায় টাকা তুলে রাখতে গিয়ে তাদের অধিকাংশই গত কয়েকটি ত্রৈমাসিকে বিপুল লোকসানের মুখে পড়েছে। এই একই সমস্যা বেসরকারি ব্যাঙ্কেরও আছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মতো

অতখানি নয়।

• রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেও ক্রমশ কমিয়ে আনা হচ্ছে সরকারি মালিকানা।

• গত তিন দশকে কোনও বেসরকারি ব্যাঙ্কের ডুবে যাওয়ার ঘটনা অন্তত এ দেশে ঘটেনি। কোনও ব্যাঙ্ক দুর্বল হয়ে পড়লে, তাকে কোনও শক্তিশালী ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে (যেমন, গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক)। ফলে আমানতকারীর টাকা খোওয়া যায়নি। অবশ্য দেশের সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না।

• রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তালিকাভুক্ত যে- কোনও ব্যাঙ্কে প্রতি গ্রাহকের এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমার নিশ্চয়তা দেয় ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড গ্যারান্টি কর্পোরেশন।

সুতরাং, সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক সঞ্চয় করার জন্য আপনার পছন্দের জায়গা হতেই পারে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্ক মানেই তাতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি সর্বক্ষণ হাঁ করে আছে, এই ধারণাও বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়।

সোনা না গোল্ড ইটিএফ?

মেয়ের বিয়ে কিংবা গিন্নিকে খুশি করার জন্য গয়না কিনতে হলে, গোল্ড ইটিএফের (এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) কথা ভাববেন না। ইটিএফ কিনতে পারেন তখনই, যদি প্রকৃত সোনার প্রয়োজন কয়েক বছর পরে হয় কিংবা যখন আপনি সোনাকে সত্যিই শুধু লগ্নির হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।

উদ্দেশ্য বিনিয়োগ হলে, একতাল সোনা কিনে তা বাড়িতে ফেলে রাখার কোনও মানে নেই। সে ক্ষেত্রে চুরি-ডাকাতির ভয় সব সময়ে তাড়া করে ফিরবে। লকারে রাখলে গুনতে হবে ভাড়া। তাই সেই সমস্ত দিক মাথায় রাখলে, লগ্নির জন্য কাগুজে সোনাই (গোল্ড ইটিএফ) ভাল।

ভবিষ্যতে সোনা কেনার প্রয়োজন থাকলেও এই ইটিএফ আপনার পক্ষে মন্দ নয়। সোনার বাজার দর ওঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে গোল্ড ইটিএফের দরও প্রায় একই অনুপাতে বাড়ে-কমে। ভবিষ্যতে যখন সত্যিই সোনার প্রয়োজন পড়বে, তখন গোল্ড ইটিএফ বিক্রি করে তা কিনে নিলেই হল।

ইটিএফ অনেকটা মিউচুয়াল ফান্ডের মতো। এর ইউনিট শেয়ারের মতোই কেনা-বেচা হয় স্টক এক্সচেঞ্জে। ফলে তা কিনতে হবে শেয়ার বাজার থেকেই। তার জন্য প্রথমেই দরকার হবে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট। শেয়ারের মতো ওই ইউনিট যখন-তখন বিক্রিও করা যায়।

করের দিক থেকে দুই-ই (ধাতু সোনা ও গোল্ড ইটিএফ) সমান।

যাঁদের ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট নেই এবং যাঁরা তা খুলতেও চান না, তাঁরা মিউচুয়াল ফান্ডের গোল্ড ফান্ডে লগ্নির কথা ভাবতে পারেন।

লগ্নির জন্য গয়না না-কেনার কথা কেন বলছি, সে বিষয়টি একটু বুঝে রাখা ভাল। মনে রাখবেন, বিক্রির সময়ে গয়নার মজুরির দাম প্রথমেই বাদ যাবে। ফলে তা পাবেন না। আর এই মজুরির অঙ্ক মোট দামের খুব ছোট অংশ কিন্তু নয়।

উদ্দেশ্য যা-ই হোক, মহিলাদের কাছে ধাতু-সোনার কদরই বেশি। তাঁদের বেশির ভাগই মনে করেন গয়না পরা এমনকী সোনা নাড়াচাড়া করার যে-সুখ, ইটিএফের কাগজে হাত রেখে তা পাওয়া সম্ভব নয়।

খাঁটি কথা। গয়না পরতে হলে সোনা কিনতেই হবে আপনাকে। কিন্তু আপনি যদি সোনায় বিনিয়োগ করতে চান, তা হলে অবশ্যই ইটিএফের কথা ভাবতে পারেন।

সেভিংস অ্যাকাউন্ট না লিকুইড ফান্ড?

সেভিংস অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। বিশেষত জন-ধন প্রকল্পে বিপুল সাফল্যের পরে সেভিংস অ্যাকাউন্ট নেই, এমন পরিবার এখন খুঁজে পাওয়া শক্ত। এই অ্যাকাউন্টে আমরা টাকা রাখি প্রয়োজন অনুসারে যখন-তখন খরচ করার জন্য।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন বেতন জমা পড়ে ওই ধরনের অ্যাকাউন্টে। সরকারের ঘর থেকে ভর্তুকিও সরাসরি জমা পড়ছে এখানে। আয়কর রিটার্নেও জানাতে হয় সেভিংস অ্যাকাউন্টের তথ্য। রিফান্ডের টাকা ফেরত আসে সেখানে। অর্থাৎ, সেভিংস অ্যাকাউন্ট এখন আবশ্যিক।

গুটিকয়েক বেসরকারি ব্যাঙ্ক বাদ দিলে, এখানে সুদ পাওয়া যায় বছরে ৪ শতাংশ। প্রত্যেকের জন্য বছরে সব সেভিংস অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদ বাবদ আয়ের উপর কোনও কর দিতে হয় না। এই অ্যাকাউন্ট নিঃসন্দেহে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডাকঘরেও এই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন।

অল্প এবং অতি অল্প সময়ের জন্য টাকা রাখা যায় মিউচুয়াল ফান্ডের লিকুইড ফান্ডেও। সেভিংস অ্যাকাউন্টের বিকল্প না-হলেও এখানে টাকা জমানোর বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে। যেমন, বাজার অনুযায়ী ৭-৮ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্ন মিলতে পারে।

বৃদ্ধির (গ্রোথ) বিকল্পে না-গিয়ে নিয়মিত আয় নিলে, এখান থেকে রোজগার কিছুটা কমে ঠিকই, কিন্তু তেমনই তা থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। জমা-বৃদ্ধি (গ্রোথ) বিকল্পে তিন বছরের বেশি টাকা ধরে রাখলে, কর গুনতে হয় নামমাত্র। সুরক্ষার দিক থেকেও লিকুইড ফান্ড বেশ ভাল। এক দিনের নোটিসে ভাঙানো যায় অনায়াসে। আর এই সমস্ত কারণেই লিকুইড ফান্ড এখন বেশ জনপ্রিয়।

যাঁদের সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে থাকে, তাঁরা নিত্যকার ও হঠাৎ প্রয়োজনের জন্য তার কিছুটা সেখানে রেখে দিন। বাকিটা সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন লিকুইড ফান্ডে। কারণ, তাতে আয় বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে।

ডিভিডেন্ড না বৃদ্ধি?

মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের জন্য যখন আবেদনপত্র ভর্তি করতে বসবেন, তখন ঠিক করতে হবে যে, আপনি ডিভিডেন্ড চান, না বৃদ্ধি (গ্রোথ)। আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া না-থাকলে, এই জায়গায় এসে আটকে যেতে হবে। অন্যকে জিজ্ঞাসা করলেই যে সদুত্তর পাবেন, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এ ক্ষেত্রে ব্রোকার তার মত জানাতে পারেন। কিন্তু তাঁর মত এবং আপনার মত এক না-ও হতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত একটু বুঝেসুঝে নেওয়া ভাল। সে জন্য নীচের কথাগুলি মাথায় রাখুন—

• নগদ টাকার প্রয়োজন থাকলে ডিভিডেন্ডে টিক দিন।

• অস্থির এবং অনিশ্চিত বাজারেও অনেক সময় ডিভিডেন্ড নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।

• লক্ষ্য যদি দীর্ঘ মেয়াদে সম্পদ সৃষ্টি হয়, তবে ‘বৃদ্ধি’ বিকল্প বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

• প্রাপকের কাছে ডিভিডেন্ড করমুক্ত থাকে ঠিকই। কিন্তু ফান্ড যখন ডিভিডেন্ড দেয়, তখন তা থেকে ডিভিডেন্ড বণ্টন কর বাদ দিয়ে তবেই তা প্রাপককে দেয়। অন্য দিকে, বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বণ্টন কর দিতে হয় না বলে

তার হার ডিভিডেন্ডের তুলনায় সাধারণত বেশি হয়।

• ইকুইটি ফান্ড এক বছর ধরে রাখার পরে বিক্রি করে লাভ হলে, তার উপর কোনও কর দিতে হয় না। আর ঋণপত্র নির্ভর ফান্ড তিন বছর ধরে রাখার পরে বিক্রি করে লাভ হলে তার উপর মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ করে (মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে) কর দিতে হয় নামমাত্র।

• বৃদ্ধি বিকল্পে তহবিল ক্রমশ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, বৃদ্ধির উপর বৃদ্ধি। উল্টো দিকে, ডিভিডেন্ড নিলে মাঝেমধ্যে হাতে টাকা আসে ঠিকই। কিন্তু সেই টাকা সাধারণত খরচও হয়ে যায়। ফলে সম্পদ সৃষ্টি হয় না।

• এসআইপি বা মাসে-মাসে কিস্তি গুনে লগ্নি করলে বৃদ্ধি বিকল্পের পথে হাঁটাই ভাল।

নগদ না ধার?

এখন তো ক্রেডিট কার্ড আর কিস্তিতে জিনিস কেনার (ইনস্টলমেন্ট) জমানা। তাই অনেক সময়েই ধন্দে পড়তে হয় যে, পণ্য নগদে কিনব, না কি ধারে—

• হাতে নগদ না-থাকলে, ধারে কেনা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু তার জন্য গোড়াতেই দেখতে হবে, সুদ বাবদ পকেট থেকে কত গচ্চা যাচ্ছে। আমি মনে করি, সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে ধার না-করাই ভাল। এ বিষয়ে সংশয় থাকলে, ধার নেওয়ার আগে অবশ্যই দু’বার ভেবে দেখা উচিত।

• হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ধারে পণ্য কেনা কোনও কোনও ক্ষেত্রে লাভজনক হতে পারে। যেমন, ধারে বাড়ি কিনলে আসল ও সুদের উপর অনেকটা করছাড় মেলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নগদ টাকা কোনও ভাল প্রকল্পে ঢেলে রিটার্ন বাবদ আয় ঘরে আসতে পারে।

• একলপ্তে ধার না-করে কিস্তিতে পণ্য কেনা যায়। গত দু’বছরে ঋণে সুদ বেশ কিছুটা কমেছে। আগামী দিনে তা আরও নামার সম্ভাবনা। এই পরিস্থিতিতে ঋণে অথবা কিস্তিতে পণ্য কেনার কথা ভাবা যেতেই পারে।

• একটি পণ্যের জন্য কিস্তি গোনা শেষ হলে তবেই পরেরটি কেনার কথা ভাবুন। নইলে হাঁসফাঁস দশা হবে।

• বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ইএমআই বা মাসিক কিস্তির অঙ্ক প্রথম দিকে বেশ ভারী মনে হতে পারে। কিন্তু কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পরে যখন আয় বাড়বে, তখন কিস্তির চাপ অনেকটাই হাল্কা মনে হয়। মাথাব্যথা কমে।

• যাঁদের আয়ের নিশ্চয়তা নেই, তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না-নেওয়াই ভাল। যাঁরা অবসর নিয়েছেন কিংবা তার কাছাকাছি চলে এসেছেন, তাঁদেরও নিয়মিত উপযুক্ত আয় না -থাকলে, লম্বা মেয়াদে মোটা ধার না-নেওয়াই ভাল। সে ক্ষেত্রে হাতে থোক টাকা এলে (যেমন ধরুন, বকেয়া বেতন), প্রয়োজন বা শখের জিনিস নগদে কেনার কথা ভাবা যেতে পারে।

কার্ড না ই-ওয়ালেট?

ডেবিট আর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সঙ্গে অনেক দিনই সড়গড় হয়ে গিয়েছি আমরা। কিন্তু এখন ভারত এগোচ্ছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র পথে। যে- পরিকল্পনা ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হলে, টাকাপয়সার লেনদেন আর এখনকার মতো থাকবে না। কার্ডের দৌলতে নগদের ব্যবহার এমনিতেই অনেক কমেছে। কিন্তু এখন সেই কার্ডকেও কড়া প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছে ইলেকট্রনিক ওয়ালেট (ই-ওয়ালেট)।

বিশেষত আধুনিক প্রজন্ম এই ই-ওয়ালেট ব্যবহারে ভীষণ সড়গড়। আমি-আপনি যেমন মানি ব্যাগে নগদ টাকা এবং কার্ড নিয়ে রাস্তায় বেরোই, তেমনই এঁরা পথ চলা পছন্দ করেন ই-ওয়ালেট নিয়ে।

এটি আদপে একটি ইলেকট্রনিক অ্যাকাউন্ট। বিভিন্ন খুচরো খরচ (ট্যাক্সি ভাড়া, সিনেমার টিকিট, রেস্তোরাঁর বিল, বিদ্যুৎ-টেলিফোন-ডিটিএইচের বিল ইত্যাদি) ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই মিটিয়ে দেন তাঁরা। যেমন ধরুন, নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫,০০০ টাকা ইলেকট্রনিক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে রাখলেন। এ বার ওই টাকা দিয়ে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নানা রকম বিল মিটিয়ে ফেলতে পারবেন।

কার্ড এবং ই-ওয়ালেট— দু’য়েরই কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে। কার্ড বলতে এখানে মূলত ডেবিট কার্ডের কথাই বলছি। যা ব্যবহার করে ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি খরচ মেটানো হয়। আসুন, দু’য়ের মধ্যে তুলনায় চোখ রাখি—

• যোগ্যতা: ডেবিট কার্ড হাতে পেতে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক। আর ই-ওয়ালেটের জন্য প্রয়োজন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আর ইন্টারনেট যুক্ত একটি স্মার্ট ফোন।

• টাকার অঙ্ক: কার্ডের মাধ্যমে ব্যাঙ্কে রাখা পুরো টাকাই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ই-ওয়ালেট মারফত ততটাই খরচ করতে পারবেন, যতটা সেখানে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আংশিক কেওয়াইসি দিয়ে ই-ওয়ালেটে রাখা যায় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর পুরো কেওয়াইসি জমা দিলে ওই ঊর্ধ্বসীমা এক লক্ষ টাকা।

• সুদ: কার্ডের ক্ষেত্রে টাকা আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্টেই থাকে। তাই সেখানে খরচ না-হওয়া টাকার উপর আপনি সুদ পাবেন। কিন্তু ই-ওয়ালেটে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়ে আসায় সুদ পাওয়ার প্রশ্ন নেই।

• সুরক্ষা: কোনও লেনদেনের জন্য সরাসরি কার্ড ব্যবহার করলে, তার জন্য দরকার পড়ে পিন নম্বর ব্যবহারের। অনলাইনে কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে দু’প্রস্ত সুরক্ষার (ভেরিফিকেশন) বন্দোবস্ত থাকে।

উল্টো দিকে, ওয়ালেটে একটিই ভেরিফিকেশন বা সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে। যা সাধারণত এক বার ব্যবহারযোগ্য পাসওয়ার্ড (ওটিপি)। কার্ড ব্যবহারে আপনার অ্যাকাউন্টের পুরো টাকাই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু ওয়ালেটের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই তা ঘটে না।

• গ্রহণযোগ্যতা: প্রায় সমস্ত বড় সংস্থা বা বিপণিই কার্ডে টাকা মেটানো নিয়ে আপত্তি করে না। ওয়ালেট চলে মূলত খুচরো বিপণিতে। সব ওয়ালেট আবার সব জায়গায় চলে না। তবে এর গ্রহণযোগ্যতাও দ্রুত বাড়ছে।

• খরচ ভাগ: কার্ডে সম্ভব নয়। কিন্তু এক দল বন্ধু খেতে গেলে ওয়ালেটের মাধ্যমে তা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া সম্ভব।

বাড়তি পাওনা: কার্ড ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে বোনান্স পয়েন্ট পাওয়া যায়। যা পরে নির্দিষ্ট জায়গায় ‘রিডিম’ (ভাঙানো) করতে পারেন। কোনও কোনও সময়ে আবার মিলতে পারে ‘ক্যাশ ব্যাক’ (দামের একটি অংশ ফেরত) পাওয়ার সুবিধাও। আর ওয়ালেটে শুধু ক্যাশ ব্যাকের সুবিধা পাওয়া যায়।

• ব্লক করা: কার্ড হারিয়ে গেলে ব্যাঙ্কের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে কিংবা ই-মেল পাঠিয়ে তা ব্লক (ব্যবহারের উপায় বন্ধ) করা যায়। ঠিক তেমনই স্মার্ট ফোন হারিয়ে ফেললে, ই-ওয়ালেট ব্লক করতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে।

সুতরাং দু’টিরই সুবিধা-অসুবিধা আছে। এমনও নয় যে, একটি ব্যবহার করলে অন্যটি করা চলবে না। তাই যেখানে যখন যেমন প্রয়োজন, বুঝেশুনে এই অস্ত্র প্রয়োগ করুন।

এফডি না এফএমপি?

ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) বা মেয়াদি আমানতের সঙ্গে আমরা পরিচিত। আজ তার সঙ্গে তুলনা টানব মিউচুয়াল ফান্ডের এফএমপি-র (ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান)।

এফএমপি অনেকটা এফডি-র মতো। নির্দিষ্ট মেয়াদের। ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্প। এর মেয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টাকা খাটে সমান মেয়াদের সরকারি ও বেসরকারি ঋণপত্রে।

যে-সমস্ত প্রকল্পের টাকা মূলত সরকারি ঋণপত্র এবং ট্রিপল্‌ এ (এএএ) রেটিংযুক্ত বেসরকারি ঋণপত্রে খাটে, তার সুরক্ষা স্বাভাবিক ভাবেই উঁচু মানের হয়।

এফএমপি-র সব থেকে বড় আকর্ষণ অবশ্য করের দিক থেকে সুবিধা। তিন বছরের বেশি মেয়াদের এফএমপি-তে লাভ হলে, তা মূলধনী লাভ বলে গণ্য হয়। এবং মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দেওয়ার পরে তাতে কর দিতে হয় নামমাত্র।

অন্য দিকে, ব্যাঙ্ক-এফডির উপর প্রযোজ্য হারে কর দিতে হয় পুরোমাত্রায়। সুতরাং সুদ ৭.৫% হলে তার উপর যদি ৩০% হারে কর দিতে হয়, তবে সেই ফিক্সড ডিপোজিটে নিট রিটার্ন দাঁড়ায় মাত্র ৫.২৫%। এই একটি বিষয়ে অন্তত এফএমপি টেক্কা দিতে পারে এফডি-কে।

কিন্তু তেমনই এফএমপি-র অসুবিধা হল, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রয়োজন পড়লেও ইচ্ছে মতো তা ভাঙানো যায় না। যে-সুবিধা ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানতে আছে।

উঁচু হারে করদাতাদের জন্য এফএমপি লগ্নির ভাল জায়গা। করের দিক থেকে সুবিধা রয়েছে বলে এখন বেশিরভাগ মিউচুয়াল ফান্ডই তিন বছরের সামান্য বেশি মেয়াদের এফএমপি প্রকল্প বাজারে ছাড়ছে।

ইকুইটি ফান্ড না ডেট ফান্ড?

• দু’টিই মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্প। প্রথমটির টাকা মূলত ইকুইটি বা শেয়ারে লগ্নি করা হয়। আর দ্বিতীয়টির টাকা প্রধানত ঢালা হয় সরকারি ও বেসরকারি ঋণপত্রে।

• ইকুইটি ফান্ডে ঝুঁকি বেশি। কিন্তু তেমনই এখানে ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পের তুলনায় আয়ের সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

• দু’ ক্ষেত্রেই ডিভিডেন্ড করমুক্ত।

• ইকুইটি ফান্ডে টাকা ঢেলে তা এক বছর বা তার বেশি ধরে রাখার পরে বিক্রি করে লাভ হলে, তার উপর কোনও কর দিতে হয় না। কিন্তু আগে বিক্রি করলে, লাভের উপর কর গুনতে হয় ১৫% হারে।

• ঋণপত্র নির্ভর ইউনিট তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাখার পরে বিক্রি করে লাভ হলে, তা দীর্ঘকালীন মূলধনী লাভ হিসেবে গণ্য হবে এবং তার উপর মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগের পরে কর গুনতে হবে নামমাত্র।

• এসআইপি পদ্ধতিতে ইকুইটি ফান্ডে টাকা ঢাললে, ঝুঁকি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সম্ভব হয় দীর্ঘ মেয়াদে ভাল মুনাফার সন্ধান পাওয়াও। উঁচু হারে করদাতাদের জন্য আবার ডেট ফান্ড টাকা রাখার বেশ ভাল জায়গা।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)

জমিই হোক বা সঞ্চয়। আপনার যে কোনও বিষয়-সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য লিখুন। ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না। ‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১। ই-মেল: bishoy@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

investment equity fund date fund
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE