দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। গলায় দলা পাকিয়ে উঠছে কান্না। সঙ্গে বাবা-মায়ের কাছে কাতর আর্তি, ‘প্লিজ... আমাকে একটু বোঝো। তোমাদের প্রত্যাশার দমবন্ধ চাপ বইতে-বইতে আমি ক্লান্ত।’
মার্কিন সংস্থা পেপসি-র নরম পানীয় মিরিন্ডার এই মিনিট তিনেকের বিজ্ঞাপন ঝড় তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। টিনএজারদের পরীক্ষা নিয়ে রাতজাগা উদ্বেগ, ভাল নম্বর পাওয়ার টেনশন আর বাবা-মায়ের প্রত্যাশা মেটানোর প্রাণান্তকর চাপ বইতে হওয়ার যন্ত্রণা সেখানে উঠে এসেছে তাদের হাতে লেখা চিঠির বয়ানে। মুখে বলতে না-পেরে যা তারা লিখেছে নিজেদের বাবা-মাকেই!
সেই সঙ্গে, বাড়ির বড়দেরও আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই বিজ্ঞাপন। তাই সেখানে সেই চিঠি পড়তে গিয়ে বাবা-মায়ের বুক ভাঙছে। অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছে মুখ। স্বপ্নের রঙিন দুনিয়া কিংবা নরম পানীয়ের সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়া স্ফূর্তির হুল্লোড় নয়। সমাজে ক্যানসারের মতো দ্রুত বাড়তে থাকা এই সমস্যাকেই বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু করেছে মিরিন্ডা!
বিজ্ঞাপন আর বিপণনের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেকে বলছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ইউটিউবে প্রকাশিত এই ফিল্ম এ ভাবে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে মূলত দু’টি কারণে।
আরও পড়ুন: প্রবীণদের ৫ লক্ষ পর্যন্ত জমায় শিথিল কড়াকড়ি
এক, আজকের প্রজন্মের চাপা দুঃখ, কষ্ট, রাগ, উদ্বেগ, যন্ত্রণা, অসহায়তা— সব কিছুই সেখানে নিখুঁত ভাবে উঠে এসেছে পরিচালক সুজিত সরকারের ক্যামেরায়। সামাজিক সমস্যা নিয়ে ‘ভিকি ডোনর’-এর মতো সিনেমা তৈরি করেছেন যিনি।
দুই, সমাজের কোনও একটি জ্বলন্ত সমস্যার উপর আলো ফেলে বিজ্ঞাপন তৈরির রেওয়াজ হালে এ দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির মধ্যে কী ভাবে বাড়ছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এখানে।
এই সমস্যা সম্পর্কে মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলেন, ‘‘সন্তানের জন্য চিন্তা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, তার কুপ্রভাব বাচ্চাদের উপরে পড়বেই।’’ একাধিক সমীক্ষাও বলছে, এই চাপের জেরে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ছোটরা। বাড়ছে অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা। মনোবিদের চেম্বারে ভিড় বাড়ছে তাদের। ডিপিএস-নিউটাউনের প্রধানশিক্ষিকা সোনালি সেন বলছেন, ‘‘একটু চাপ থাকলে হয়তো নিজের সবটুকু উজাড় করার তাগিদ বাড়ে। কিন্তু তা বলে চাপ মানে একতরফা প্রত্যাশা নয়। ছোটদের সঙ্গে অনবরত আলোচনা করা, তাদের সময় দেওয়া জরুরি। দরকার তাদের মন বোঝা।’’
দেখুন ভিডিও:
সেখানে ফাঁক থেকে যায় বলেই এই বিজ্ঞাপনে কেউ বলছে, ‘‘আগের পরীক্ষার ফল ভাল হয়নি। কিন্তু এ বার খুব চেষ্টা করছি। ইচ্ছে শুধু পড়ার ফাঁকে একটু-আধটু ফুটবল দেখার। কিন্তু টিভির কানেকশনই যে কাটা!’’ আবার কারও অভিযোগ, পড়ার চাপে সে ‘নার্ভাস’ নয়। আতঙ্কিত বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা দেখে। কারও আর্জি, ‘‘প্লিজ, সকলের সামনে আমাকে নিশি আন্টির মেয়ের সঙ্গে তুলনা কোরো না।’’ কেউ বলছে প্রতি আধঘণ্টা অন্তর তার উপর নজরদারি বন্ধ করার কথা। এক খুদের প্রশ্ন, ‘‘আমার সঙ্গে কথার সময়েও বাবার মন সেই অফিসেই পড়ে থাকে কেন?’’
বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় বহু দিন যুক্ত এক জন বলছিলেন, ‘‘খেয়াল করে দেখবেন, এই সমস্যা আজ ঘরে-ঘরে। আর নিজেদের টার্গেট অডিয়েন্সের (যারা আগামী দিনে পণ্য কিনতে পারে) সেই মোক্ষম জায়গাতেই ঘা দিয়েছে এই বিজ্ঞাপন।’’ পেপসি-ইন্ডিয়ার অন্যতম বিপণন কর্তা গৌরব বর্মার দাবি, এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিই এই ফিল্মের মূল লক্ষ্য। বিপণন গুরু রাম রায়ের কথায়, ‘‘পথে-ঘাটে যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার সঙ্গে সাযুজ্য থাকা বিজ্ঞাপন সহজে নজর কাড়ে। একই সঙ্গে,
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তুলে ধরার সুযোগও পায় সংস্থা।’’
বিদেশে তো বটেই, এখন ভারতেও বিজ্ঞাপনের বিষয় হিসেবে বারবার ঘুরেফিরে আসছে সামাজিক সমস্যা ও সমসাময়িক ঘটনার কথা। তা সে ২৬/১১-র মুম্বই সন্ত্রাস হোক বা ভোট দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি। আমূলের বিজ্ঞাপন যেমন এ ক্ষেত্রে আলাদা জায়গাই তৈরি করে নিয়েছে। ক্রিকেট বেটিং থেকে শুরু করে অ্যাম্বাসাডরের হাতবদল— সাড়া ফেলে দেওয়া সমস্ত ঘটনাই সাধারণত ঠাঁই পায় আমূলের বিজ্ঞাপনে। ভোট দেওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কে নতুন ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য ২০০৮ সালে সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল টাটা টি-র ‘জাগো রে’ ক্যাম্পেন। বিজ্ঞাপনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সজাগ ও সক্রিয় থাকার প্রচার করেছে মোবাইল পরিষেবা সংস্থা আইডিয়া। এমনকী দিল্লিতে ভয়াবহ ‘নির্ভয়া কাণ্ড’ও জায়গা পেয়েছে বিজ্ঞাপনের পরিসরে।
বিপণন দুনিয়ার এক পেশাদার বলছিলেন, ‘‘বিজ্ঞাপনে সারাক্ষণ নিজেদের জয়ধ্বনি না করে বরং সমাজের আয়না হতে পারলে যে প্রচার ভাল হয়, তা ক্রমশ আরও বেশি করে বুঝছে কর্পোরেট দুনিয়া।’’ সাড়া ফেলে দেওয়া এই বিজ্ঞাপনেও মিরিন্ডার নাম এসেছে একেবারে শেষে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক সমস্যা তুলে ধরার বুনোট নিখুঁত হলে, সম্ভাব্য ক্রেতার মাথায় নিজেদের নাম গেঁথে দিতে ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy