উত্সবের মরসুমে বাজারের উজান টানে বাদ পড়েনি শহর কলকাতাও।
গয়না থেকে গাড়ি। পোশাক থেকে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য। প্রায় সব জিনিসের বিক্রির মাপকাঠিতেই এ বারের উত্সবের মরসুম বহু যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে গত বেশ কয়েক বছরকে। দিল্লি হোক বা লখনউ। বহুজাতিক হোক বা ছোট সংস্থা। শপিং মল বা ছোট বিপণি। প্রায় সকলেই জানাচ্ছে, এ বার আক্ষরিক অর্থেই অকৃপণ ছিল উত্সবের বাজার। দেশের অধিকাংশ শহরে বিক্রিবাটা যা হয়েছে, গত কয়েক বছরে তা হওয়া তো দূরের কথা, চিন্তাও করা যায়নি। এমনকী শিল্পে খরা, মলিন ভাবমূর্তি সব ‘সামলে’ সেখানে সামিল হয়েছে কলকাতা-সহ রাজ্যও। বহু কাল পরে কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থায়ী সরকার আর তার হাত ধরে দেশে অর্থনীতির চাকা অন্তত ঘুরতে শুরু করার ইঙ্গিতকেই এর কারণ বলে মনে করছে শিল্পমহল।
এমনিতে বিক্রির বিচারে বছরের অন্য যে-কোনও সময়কে বরাবর টেক্কা দেয় উত্সবের মরসুম। শুধু এ বার নয়, প্রায় প্রতিবারই। কিন্তু ছোট-বড় বিপণি ও সংস্থার দরজায় এ বারের উত্সবের মরসুম এসেছিলই যেন উপহারের ঝুলি হাতে নিয়ে। লখনউয়ে দীপাবলি উপলক্ষে কেনা পণ্য ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দিতে দিনে ৩০০টি গাড়ি বেশি ভাড়া করতে হয়েছে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্যের এক ডিলারকে। দিল্লিতে দিনে তিন-চার হাজার টেলিভিশন বিক্রি করেছে এক জাপানি সংস্থা। এমনকী খাস কলকাতায় ওই সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৪০০টি গাড়ির চাবি ক্রেতার হাতে তুলে দিয়েছে একটি সংস্থা। শুধু দু’একটি শহর, গুটিকয়েক সংস্থা বা কয়েকটি বিপণির বিক্রিবাটাই যে এমন উজ্জ্বল ছিল, তা নয়। বরং এই ছবি রাজ্য-সহ দেশের প্রায় সর্বত্র।
গত দু’বছর ছাড়, উপহারের টোপ কোনও কিছু দিয়েই ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় টানতে পারেনি সোনি, স্যামসাং, এলজি, ভিডিওকনের মতো বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য সংস্থা। কিন্তু সেই ফ্যাকাসে রং মুছে ওই পণ্যের বাজারে এ বার রোশনাই। দুর্গাপুজো-দীপাবলির ওই সময়ে টিভি-ফ্রিজ-মোবাইলের বিক্রি এতটাই বেড়েছে যে, সেই রমরমা নতুন বছরের গোড়া পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ার আশা করছে সংশ্লিষ্ট শিল্প।
সোনি ইন্ডিয়ার অন্যতম কর্তা সুনীল নায়ার জানান, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি বিক্রি বেশি হয়েছে এ বারের উত্সবের মরসুমে। একই সুর প্যানাসোনিকের কর্তা মনীশ শর্মার কথায়। ক্রোমার প্রধান অজিত যোশীর দাবি, সমস্ত বিপণি থেকেই বিপুল পরিমাণে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য বিক্রি করেছেন তাঁরা। বিক্রি যথেষ্ট ভাল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিডিওকনের কর্তা অনিরুদ্ধ ধুতও।
উত্সবের এই কেনাকাটায় দিল্লি-মুম্বইয়ের সঙ্গে কড়া টক্কর দিয়েছে কলকাতাও। সারা দেশে ফ্যাব ইন্ডিয়ার বিক্রি বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। কলকাতায়ও ওই হার ৩১%। সিটিমার্টের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা জ্যোতিরিন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, জামা, জুতো ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের বিক্রি গত বারের তুলনায় প্রায় ২৫% বেড়েছে। প্যান্টালুন্সের বেড়েছে ১০%। বৈদ্যুতিন পণ্যের ক্ষেত্রেও গ্রেট ইস্টার্ন, খোসলা ইলেকট্রনিক্সের মতো বিপণিতে ব্যবসা বেশি হয়েছে অন্তত ৪০%।
উত্সবের মরসুমে চমক দেখিয়েছে সোনা-হিরের গয়নাও। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা পঙ্কজ পারেখের দাবি, “২০১৩ সালের তুলনায় ২০% ব্যবসা বেশি হয়েছে। সোনার দাম কম থাকায় গয়নার দামও ১০-১২% কমেছে। ফলে তা কিনতে পিছপা হননি ক্রেতারা। একই মতের শরিক অঞ্জলি জুয়েলার্সের অনর্ঘ্য চৌধুরী। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, শুধু সোনা নয়, এ বার হিরের গয়নাও বিকিয়েছে যথেষ্ট। দামি, শৌখিন জিনিসের পাশাপাশি বিক্রি বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেরও। যেমন বিগ বাজার কর্তৃপক্ষের দাবি, এ বারের উত্সবের মরসুমে বিক্রি সংস্থার ইতিহাসে রেকর্ড।
উত্সবের আলোয় রঙিন হয়েছে দীর্ঘ দিন মুষড়ে থাকা গাড়ির বাজারও। সম্প্রতি ‘এলিট-আই২০’ গাড়িটি বাজারে এনেছে হুন্ডাই। সংস্থার দাবি, বাজারে আসার পরে মাত্র ২০ দিনেই ১৫,৩০০টি বুকিং পেয়েছে তারা। বাজারে আসার আগেই ১০ হাজার বুকিং জুটেছে মারুতি-সিয়াজের। বিক্রি বেড়েছে অডি, বিএমডব্লিউ-র মতো বিলাসবহুল গাড়িরও।
তবে কিছুটা ভিন্ন ছবি শাড়ির ব্যবসায়। প্রিয়গোপাল বিষয়ীর সৌম্যজিত্ লাহার কথায়, “শাড়ি বিক্রি এ বার তেমন বাড়েনি। বড় দোকানে বিক্রি ৫-৬ শতাংশ বাড়লেও, ছোট দোকানে তা মার খেয়েছে। উত্সবের সময়ে শাড়ি বিক্রি যে-হারে বাড়ে, সেই ছবি এ বার দেখা যায়নি।” তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে শাড়ি পরার চল কমে যাওয়া তার একটা কারণ কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় সংশ্লিষ্ট মহল।
তবে সব মিলিয়ে, হাতে গোনা কিছু পণ্য বাদ দিলে, সার্বিক ভাবে এ বার বাজারে বিক্রির এই রোশনাইকে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরার শুরু হিসেবেই দেখছে শিল্প ও বণিকমহল। তাঁদের মতে, কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এসেছে। প্রথম পাঁচ-ছ’মাসে অন্তত সংস্কারের পথে হাঁটার আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা। কল-কারখানা গড়তে দেশি-বিদেশি লগ্নি টানার জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বারবার বলছেন বিপুল সংখ্যায় কাজের সুযোগ তৈরির কথা। এই সব কিছুর দৌলতে অর্থনীতিতে আশার একটা বাতাবরণ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। যেমন মনীশ শর্মা বলেছেন, স্থিতিশীল সরকার ও নির্দিষ্ট নীতির কারণে স্বস্তির আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। আর তারই প্রভাবে তুঙ্গে উঠেছে বাজার। অর্থনীতির এই ‘ফিল গুড’ পরিবেশকে কৃতিত্ব দিয়েছেন অনর্ঘ্যবাবুও।
আগামী দিনে অর্থনীতি পুরোদস্তুর ঘুরে দাঁড়ালে, উত্সবের মরসুমে বিক্রির এই রেশ কম-বেশি বছরভর উপভোগ করা যাবে বলেই আশায় বুক বাঁধছে শিল্পমহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy