Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পড়তে চেয়ে কোর্টে গেল অন্য ঈশান

সিবিএসই-র নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের রোগাক্রান্ত পড়ুয়াদের জন্য কিছু বিশেষ বিষয়ের পাঠ্যক্রম থাকে। তারই একটি বিষয় হল পেন্টিং।

সৃজন: রং-তুলিতে মগ্ন সঙ্কল্প। বৃহস্পতিবার বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী। (ইনসেটে) ‘তারে জমিন পর’ সিনেমার একটি দৃশ্য।

সৃজন: রং-তুলিতে মগ্ন সঙ্কল্প। বৃহস্পতিবার বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী। (ইনসেটে) ‘তারে জমিন পর’ সিনেমার একটি দৃশ্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৩১
Share: Save:

ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত এক ছাত্রকে দ্বাদশ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ভরার সুযোগ না দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে বালিগঞ্জের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাইল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী কেন্দ্রের আইনজীবীকে নির্দেশ দিয়েছেন, আজ, শুক্রবারের মধ্যে এ বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আদালতকে জানাতে হবে। বিচারপতি এ দিন মন্তব্য করেন, ‘‘বিষয়টি মানবিক। গুরুত্ব দিয়ে তা বিবেচনা করা প্রয়োজন।’’

সঙ্কল্প দাস নামে ওই ছাত্রের বাবা দেবাশিস দাস অভিযোগটি তুলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, ওই স্কুলেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে সঙ্কল্পের ডিসলেক্সিয়া ধরা পড়ে। স্কুল মারফত গোটা বিষয়টি জানানোর পরে সিবিএসই কর্তৃপক্ষ তাকে পেন্টিং নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। সিবিএসই-র নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের রোগাক্রান্ত পড়ুয়াদের জন্য কিছু বিশেষ বিষয়ের পাঠ্যক্রম থাকে। তারই একটি বিষয় হল পেন্টিং।

আইনজীবী জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর মক্কেলকে জানিয়ে দেন, ওই বিষয়ে লেখাপড়া চালাতে হলে তাঁকেই ছেলের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের খরচ বহন করতে হবে। কারণ, ওই স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। দেবাশিসবাবু তাতে রাজি হন। ওই বিষয়ে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয় সঙ্কল্প। স্কুলের শিক্ষকেরা তখন তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন আরও এগিয়ে যাওয়ার। মা খুকু দাস জানান, একাদশ শ্রেণিতেও তার বিষয় হয় পেন্টিং। সঙ্গে রয়েছে হোম সায়েন্স, ভূগোল, সঙ্গীতও। প্রথমে বেশ কিছু দিন ভাল ভাবেই চলছিল ক্লাস। অভিযোগ, হঠাৎ নতুন অধ্যক্ষ জানান, বাকিদের মতো পাঠ্যক্রমেই পরীক্ষা দিতে হবে সঙ্কল্পকেও। এর পরে কিছু দিন অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও ওই ছাত্র লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে। চলতি বছরের অগস্ট মাসে একাদশ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠার পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে স্কৃল কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে আরও অসহযোগিতা করতে থাকেন বলে দেবাশিসবাবুর অভিযোগ। তাতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সঙ্কল্প। তাই কিছু দিন সে স্কুলেও যেতে পারেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সঙ্কল্পের বাবার অভিযোগ, অনুপস্থিতির কারণে তাঁর ছেলের নাম স্কুলের খাতা থেকে বাদও দিয়ে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক অনুরোধ করার পরে গত অক্টোবর মাসের ৩০ তারিখ তাঁকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, ২৮ অক্টোবরের মধ্যে সঙ্কল্পকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষায় বসার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। যা করা আদৌ সম্ভব ছিল না, কারণ তত দিনে সেই সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এর পরেই ছেলেকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন দেবাশিসবাবু।

বলিউডের ‘তারে জমিন পর’ ছবি আট বছরের এক ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত শিশু ঈশান নন্দকিশোর অবস্থির দুর্দশার কথা দেখিয়ে সাড়া ফেলেছিল দেশ জুড়ে। বিশেষজ্ঞদের আশা ছিল, সেই ছবি দেখে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়েছে জনসাধারণের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবের ঈশানদের পরিস্থিতি যে আদৌ বদলায়নি, তা ফের সামনে এনে দিল সঙ্কল্পের ঘটনা। শুধু সঙ্কল্পই বা কেন, কয়েক দিন আগেই সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত যুবক সনৎকুমার মৈত্র অনেক আবেদনের পরেও আধার কার্ড না পাওয়ায় আদালতে দ্বারস্থ হতে হয় তাঁর মাকে। শেষে বিচারপতির হস্তক্ষেপে সনতের আধার কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

ডিসলেক্সিয়া কী?

উপসর্গ

তাড়াতাড়ি পড়া, মুখে শব্দ করে জোরে জোরে পড়া, বানান করা— পড়াশোনার এমন খুঁটিনাটিতে সমস্যা দেখা দেয় ডিসলেক্সিকদের ক্ষেত্রে।

চিকিৎসকেরা বলছেন

শিক্ষা কী ভাবে?

আইন বলছে

সঙ্কল্পের স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি বৃহস্পতিবার। তবে সঙ্কল্পের মামলার শুনানিতে কেন্দ্রের আইনজীবী এ কে বাগ দাবি করেন, সঙ্কল্পের অভিভাবকেরা সিবিএসই কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক প্রয়োজনীয় নথি জমাই দেননি। তা ছাড়া, টানা অনুপস্থিত থাকায় নিয়ম মতোই স্কুলের খাতা থেকে ওই ছাত্রের নাম বাদ পড়েছে। দেবাশিসবাবুর আইনজীবী দাবি করেন, স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে সব নথি দেওয়া হয়েছে। তিনি এ-ও জানান, সঙ্কল্প যে ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত, সেই ব্যাপারে চিকিৎসকের শংসাপত্রও রয়েছে স্কুলের কাছে। দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরেই এ দিন স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চেয়ে কেন্দ্রের আইনজীবীকে ওই নির্দেশ দেন বিচারপতি।

আরও পড়ুন: মানিককে অফিসেই ঢুকতে দিল না বিজেপি

এ দিকে সঙ্কল্পের স্কুলের শিক্ষকদের একাংশের অনুমান, ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ওই ছাত্র বোর্ডের পরীক্ষায় বসে খারাপ ফল করলে স্কুলের বদনাম হতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকেই তাকে আর এগোতে দিতে চাইছেন না কর্তৃপক্ষ। এক শিক্ষিকা জানান, হঠাৎ করে কেন অসহযোগিতা করতে শুরু করলেন কর্তৃপক্ষ, তা বুঝতে পারছেন না তাঁরাও। তবে ওই স্কুলে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কয়েক জন যে যথেষ্ট সহিষ্ণু নন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের প্রতি, তা কিছু দিন আগে আর এক ছাত্রীর ঘটনাতেও টের পেয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন আর এক ছাত্রীকেও এই স্কুল ছাড়িয়ে অন্যত্র ভর্তি করতে হয়েছে তার অভিভাবকদের।

আর কী বলছে সঙ্কল্প? মা খুকুদেবী জানালেন, পড়াশোনায় এমন বাধা পড়ায় ভেঙে পড়েছে ওই ছাত্র। মাঝে কিছু দিন খুবই অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে তার। তবে আদালত যে তার কথা শুনছে, তাতেই নতুন করে আশার আলো দেখছে সে। এ দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে আদালতে গিয়েছিল সঙ্কল্পও। সে-ও যে শুনতে চায়, কোন দিকে গড়াবে তার ভবিষ্যৎ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE