Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শতচ্ছিদ্র অগ্নিবিধি, অবাধেই চলছে রেস্তোরাঁ

জবাব মেলে, ‘‘ওটা সপ্তাহখানেক আগেই বন্ধ করা হয়েছে।’’ পার্কের কর্তৃপক্ষকে সব নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বেরিয়ে যান দমকলের কর্তারা।

ফস্কা গেরো: পার্ক স্ট্রিটের ম্যাকডোনাল্ডসে দমকলের পরিদর্শন ।

ফস্কা গেরো: পার্ক স্ট্রিটের ম্যাকডোনাল্ডসে দমকলের পরিদর্শন ।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০১
Share: Save:

উৎসবের মরসুমে পার্ক স্ট্রিট এলাকায় পানাহার সারতেই পারেন। কিন্তু বিপদে পড়লে বাঁচার জন্য কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ লাগতে পারে। শনিবার অগ্নিসুরক্ষার পরিদর্শন সেরে এমনই মনে করছেন দমকলকর্তাদের একাংশ। মুম্বইয়ের হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ পাড়ায় আচমকা হানা দিয়েছিলেন তাঁরা। তাতেই ধরা প়ড়েছে সুরক্ষার ফাঁকফোকর।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরামর্শ, হুঁশিয়ারি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু ম্যাকডোনাল্ডসকে দফতরে তলব করেছেন দমকলকর্তারা। কারণ, দমকলের ছাড়পত্র ছাড়াই দিব্যি ব্যবসা চালাচ্ছে ওই রেস্তোরাঁ!

এ দিন দুপুর ১টায় পরিদর্শনের শুরুতেই দমকলের ডিভিশনাল অফিসার অভিজিৎ পাণ্ডের নেতৃত্বে একটি দল পার্ক হোটেলে পৌঁছে যায়। প্রথমেই দলটি যায় সুইমিং পুলের কাছে। সেখান থেকে আপৎকালীন নির্গমন পথ (ইমার্জেন্সি এগজিট) দেখতে চাওয়া হয়। দমকলকর্তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা যায়, খুবই সরু পথ সেটি। এর পরেই হোটেলের নাইটক্লাবে যায় দমকলের দলটি। সেখানে বিপদে প়ড়লে পালাতে হবে সরু রাস্তা বেয়ে রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে। এমনই সে রাস্তা যাতে পাশাপাশি দু’জনে চলা যায় না। প্রশ্ন উঠেছে, বিপদে পড়লে মানুষে কি লাইন করে ধীরেসুস্থে বেরোবেন সেই পথ দিয়ে?

পার্কের ডিরেক্টর (ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রতীর দত্ত দাবি করেন, ‘‘এটা ছাড়াও চওড়া পথ রয়েছে।’’ সেই পথ অবশ্য দমকলকর্তাদের দেখানো হয়নি। এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, তন্ত্রের ভিতরে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে হুকা পরিবেশন হয় কী ভাবে? জবাব মেলে, ‘‘ওটা সপ্তাহখানেক আগেই বন্ধ করা হয়েছে।’’ পার্কের কর্তৃপক্ষকে সব নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বেরিয়ে যান দমকলের কর্তারা।

এর পরেই দলটি পৌঁছয় অলিপাবে। সেখানে কমবেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিপদে পড়লে যে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে, তা যথেষ্টই খাড়া! যে ভাবে মেজেনাইন ফ্লোর তৈরি হয়েছে, তা-ও যথাযথ নয়। আপৎকালীন নির্গমনের রাস্তাও সরু। যদিও সেখানকার বার ম্যানেজার তায়েব আলির দাবি, তাঁরা স্প্রিঙ্কলার, অ্যালার্ম লাগিয়েছেন। সব নিয়মই মানা হয়। এর পরেই দলটি ঢোকে ওই পাড়ার আর এক পুরনো রেস্তোরাঁ মুলাঁ রুজে। সেখানে গিয়ে প্রথমে কোনও কর্তাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। জলের পাইপের বাক্সটিও তড়িঘড়ি খোলা যায়নি। তা নিয়ে দমকলকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে রেস্তোরাঁর কর্তারা এসে সব কাগজপত্র দেখান।

অপরিসর আপৎকালীন নির্গমনের রাস্তা পিটার ক্যাট। শনিবার।

মুলাঁ রুজ থেকে বেরিয়ে ‘বার বি কিউ’-এ ঢুকতেই ফের হোঁচট। অলিগলি পেরিয়ে বিপদে পালানোর রাস্তা ধরতেই অবাক দমকলকর্তারা। সেখানে দিব্যি টেবিল সাজিয়ে পরিবেশনের আগে খাবার সাজানো হচ্ছে। মূল আপৎকালীন দরজার তালা বন্ধ। আর একটি পালানোর পথ রয়েছে বটে। কিন্তু সেটির উচ্চতা মেরেকেটে চার ফুট হবে। অর্থাৎ, পালাতে হলে কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হবে এবং তার পরেও যে সহজে পালানো যাবে, এমনও নয়। এ দেখে এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘ছাড়পত্র নেওয়ার সময়ে সব সাজিয়ে রাখে। কিন্তু সে সব মিটে গেলেই সব নিজেদের ইচ্ছেমতো চালায় এরা।’’ এ সব নিয়ে ‘বার বি কিউ’-এর কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তাঁরা দমকল কর্তৃপক্ষকে জানান, গাফিলতি শুধরে নিয়ে নিয়ম মেনেই চলা হবে। কিন্তু এর থেকেও বড় চমক অপেক্ষা করছিল ম্যাকডোনাল্ডসে।

ঝকঝকে রেস্তোরাঁয় বারবার দমকলকর্তাদের আপ্যায়নের চেষ্টা হয়। কিন্তু আমল না দিয়ে সটান রান্নাঘরে অফিস পরিদর্শনে ঢোকেন এক অফিসার। ধরা পড়ে ছাড়পত্র না থাকার বিষয়টি। ছাড়পত্রের প্রসঙ্গ বারবারই এড়িয়ে যেতে থাকেন কর্তৃপক্ষ। শেষমেশ তিনি কাগজপত্র নিয়ে আসেন। দমকলকর্তা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার বিজিত সমাদ্দারকে প্রশ্ন করেন, ‘‘এটা তো ২০০৯ সালে দেওয়া হয়েছিল। আজকের তারিখ কত? ছাড়পত্র আদৌ আছে কি?’’

বিজিতবাবু জানান, ট্রেড লাইসেন্স মেলেনি বলে দমকলের ছাড়পত্র নিতে পারেননি। আবার বলেন, দমকলের ছাড়পত্রের আর্জি জানিয়েছেন। কিন্তু সেই আর্জি দাখিলের রসিদ দেখাতে পারেননি। এর পরেই অভিজিৎবাবু তাঁকে সব কাগজ নিয়ে অফিসে যেতে বলেন। গাফিলতির জন্য মামলা রুজু করার হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু এত বছরে এই ছাড়পত্র না থাকার বিষয়টি নজরে এল না কেন, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তা হলে কি নজরদারিতেও ফাঁক আছে? পরিদর্শনে থাকা দমকল কর্তাদের জবাব, সব রেস্তোরাঁ এক বারে দেখা হয় না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান চলে। প্রশ্ন উঠেছে, গত সাত বছরে এক বারও কি ম্যাকডোনাল্ডসে যাননি কর্তারা? এর অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।

ঘটনাচক্রে এই রেস্তোরাঁর উল্টো দিকেই অগ্নিকাণ্ডের দগদগে স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে স্টিফেন কোর্ট। তার একতলায় পিটার ক্যাট রেস্তোরাঁতেও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বেরোনোর পথে প্রায় দু’ফুট উঁচু চৌকাঠ বসানো। বিপদে তড়িঘড়ি যা পেরোতে কষ্ট হবে সকলেরই। তা দিয়ে বেরিয়েও কার্যত ঘিঞ্জি একটি উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সেখানে গিয়েই একটি লোহার সিঁড়ি দেখিয়ে এক দমকলকর্তার উক্তি, ‘‘এই সিঁড়ি দিয়েই পু়ড়ে যাওয়া স্টিফেন কোর্ট থেকে একের পর এক দেহ নামিয়েছিলাম।’’ কিন্তু এমন কষ্টসাধ্য বেরোনোর পথ কেন? পিটার ক্যাটের কর্ণধার সিদ্ধার্থ কোঠারির বক্তব্য, আপৎকালীন দরজার তলা দিয়ে জল ঢুকে প়়ড়ছিল বলে চৌকাঠ তৈরি হয়েছে। সেটা সরিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

প্রশ্ন উঠেছে, এত অনিয়ম সত্ত্বেও এই রেস্তোরাঁগুলি ছাড় পায় কী ভাবে? অভিজিৎবাবুর বক্তব্য, পুরনো বাড়িতে সব বিধি মানা সম্ভব নয়। তাই যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। নজরদারির সময়ে অনিয়ম হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fire department দমকল Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE