মোটেই নিরাপদ নন কলকাতাবাসী। যে কোনও সময়ে, যে কোনও জায়গায় তাঁদের শরীরে ঢুকতে পারে যক্ষ্মার জীবাণু। তা এমন মারাত্মকও হতে পারে যে প্রচলিত ওষুধে সারবে না, দরকার হবে অনেক কড়া ওষুধ। সেই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক তীব্র এবং যন্ত্রণাদায়ক। রোগ সারতেও অনেক সময় লাগবে। অর্থও খরচ হবে দ্বিগুণ।
স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করছেন, পরিস্থিতি এমন হওয়ার কারণ কলকাতায় বেসরকারি স্তরে ঠিক কত যক্ষ্মারোগী রয়েছেন, তাঁদের ঠিকানা কী এবং তাঁদের কোথায়, কতটা চিকিৎসা হচ্ছে সে সম্পর্কে কার্যত তথ্যের নামগন্ধ নেই। স্বাভাবিকভাবেই তৈরি করা যাচ্ছে না আগাম যক্ষ্মা প্রতিরোধের রূপরেখা। বহু রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে ওষুধে কাজ হবে না এমন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাঁদের থেকে বাসে-ট্রামে, পথ চলতে সকলের অজান্তেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে মাল্টি ড্রাগ রেজিসট্যান্ট যক্ষ্মা (এমডিআর)— যার উপর প্রচলিত ওষুধ কাজ করে না।
স্বাস্থ্যকর্তারা নিজেরাই জানাচ্ছেন, এ দেশে যক্ষ্মা রোগীদের ৬০ শতাংশই বেসরকারি স্তরে চিকিৎসা করান। কিন্তু খাস কলকাতায় গত তিন মাসে শুধু সরকারি ক্ষেত্র থেকে ৪৬ জন নতুন যক্ষ্মা রোগী মিলেছে। এর মধ্যে চার জন এমডিআর টিবিতে আক্রান্ত। স্বাস্থ্যকর্তারা অনেকেই মানছেন, বেসরকারি ক্ষেত্রের পুরো তথ্য পাওয়া গেলে কলকাতায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যাটা অন্তত এর দ্বিগুণ হত। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসকদের চেম্বার, ল্যাবরেটরি, বা ওষুধের দোকান— কোথাও থেকেই জোগাড় হচ্ছে না সেই তথ্য। কেউ বলছেন সময় নেই, কেউ অজুহাত দিচ্ছেন লোকবল কম থাকার।
অথচ উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলি বেসরকারি স্তর থেকে যক্ষ্মার তথ্য সংগ্রহে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের অতিরিক্ত-অধিকর্তা (টিবি) শান্তনু হালদার ব্যাখ্যা করেন, গত এক বছরে উত্তর ২৪ পরগনার বেসরকারি হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি, ওষুধের দোকান থেকে ৫২৯ জন নতুন যক্ষ্মা রোগীর হদিস মিলেছে। হাওড়া জেলায় মিলেছে ৪০২ জন নতুন রোগীর সন্ধান। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অপেক্ষাকৃত দেরিতে কাজ শুরু হলেও গত ২ মাসে ৩৫ জন রোগীকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। সেই তুলনায় কলকাতায় ১০টি হেল্থজোনের বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে গত এক বছরে সংখ্যাটা টেনেটুনে ২০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গত মে-জুন মাসে ১৫২ জন রোগীর তথ্য এসেছে ট্যাংরা ডিভিশন থেকে। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, সার্বিকভাবে গত ছ’মাসে কলকাতা থেকে কোনও তথ্যই মেলেনি।
চার বছর আগে যখন যক্ষ্মা ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’ বলে ঘোষণা হয়েছে এবং যেখানে বাকি জেলাগুলি বেসরকারি স্তর থেকে তথ্য পাচ্ছে, তখন কলকাতায় কেন তা হবে না?
কলকাতায় জাতীয় যক্ষ্মা নিবারণ কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্বে রয়েছে ‘যক্ষ্মা নিবারণ সোসাইটি’। এর সদস্য-সচিব কলকাতা পুরসভা-মনোনীত সিটি টিবি অফিসার সৌমিত্র ঘোষের আফশোস, ‘‘আমাদের অনুমান, কলকাতায় বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫ হাজার নতুন যক্ষ্মা রোগী মেলে। কিন্তু তাঁদের নিরানব্বই ভাগের তথ্য আমাদের কাছে আসে না। এই প্রবণতা দেশের যক্ষ্মা-নীতির পরিপন্থী।’’
তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় ১০টি আর্বান হেল্থ ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে। প্রথম এক মাস তারা খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করল। তার পরে সব বন্ধ। দোকানদারদের প্রায় সকলেই দাবি করছেন, তাঁরা আর যক্ষ্মার ওষুধ বিক্রি করছেন না। তাই রোগীও পাচ্ছেন না। অনেক দোকান আবার রোগীদের যে ঠিকানা দিচ্ছে, সেখানে ওই নামের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।’’ আবার বেসরকারি চিকিৎসকদের কেউ কেউ বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ। কেউ জানাচ্ছেন, তাঁদের তথ্য দেওয়ার সময় নেই। কেউ আবার রোগী হাতছাড়া হওয়া বা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তথ্য দিতে চাইছেন না বলে জানান সৌমিত্রবাবু। পুরসভার এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘বেসরকারি স্তরে কেউ যক্ষ্মা রোগী পেলেও তা নথিভুক্ত না করান, তা হলে কী শাস্তি হবে তা স্পষ্ট নয়। সেই ফাঁক গলে চলছে দেদার ফাঁকি।’’
বাগবাজারের টিবি অফিসার চন্দ্রশেখর দাস, স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড এলাকার টিবি অফিসার পলাশ দে, ট্যাংরার অফিসার অপ্রতিম মিত্র বা মানিকতলার টিবি অফিসার দিলীপ রায়ের মতো অনেকে আবার মনে করেন, বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে নিয়মিত তথ্য পেতে হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাগাদা দেওয়া, তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের জন্য বিপুল লোক নিয়োগ করতে হবে। যা করেই হাওড়া বা উত্তর চব্বিশ পরগনা সাফল্য পেয়েছে।
কী বলছে ওষুধের দোকানদারদের সংগঠন বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন? তাদের এক মুখপাত্র বলেন, ‘‘অধিকাংশ দোকানে লোক কম। তাঁরা রোগী সামলাবেন, টাকা-পয়সা, ওষুধের স্টকের হিসেব রাখবেন, না কি যক্ষ্মা রোগী ও তাঁদের চিকিৎসার কথা নথিভুক্ত করবেন?’’ চিকিৎসকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য জানিয়েছে, তাদের সদস্য চিকিৎসকদের নিয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা শিবির করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy