খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার বলছেন, ‘‘শহর থেকে ঠিক মতো বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।’’ ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আগে থেকে তাঁর অফিসারেরা সেই অস্ত্রের সন্ধান পাচ্ছেন না। সোমবার কলকাতা পুলিশের মাসিক ক্রাইম বৈঠকে সিপি-র এই দুই মন্তব্যের পরে অনেকেরই মত, ঠারেঠোরে সিপি নিজেই কবুল করছেন, এ শহরে মজুত রয়েছে প্রচুর বেআইনি অস্ত্র। তাঁরই পুলিশের তল্লাশি অভিযানে খামতি রয়েছে, কার্যত মানছেন সে কথাও। শুধু তা-ই নয়। এ দিন কমিশনার এ-ও বলেন, ‘‘কোনও ঘটনাকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়। অনেক সময়ে ছোট ছোট ঘটনা থেকেই বড় ঘটনা ঘটে।’’ অনেকের মতে যার অর্থ, খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বিভিন্ন ঘটনাকে ‘ছোট ঘটনা’ বলে অভিহিত করলেও তাঁরই প্রশাসনের পুলিশকর্তা সে পথে হাঁটার পক্ষপাতী নন।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে সিপি সোজাসাপ্টা বলেন, ‘‘শহরে গুলি চলছে, লুঠতরাজ হচ্ছে। অভিযুক্ত দুষ্কৃতীরাও ধরা পড়ছে। অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু আগে থেকে অফিসারেরা ওই অস্ত্রের সন্ধান পাচ্ছে না কেন?’’ সেই প্রসঙ্গেই লালবাজারের অন্দরে উঠে এসেছে, গিরিশ পার্ক কাণ্ডে অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারির বাড়িতে বেআইনি অস্ত্র ভাণ্ডারের কথা। অভিযোগ, গোয়েন্দাদের একাংশের ‘সোর্স’ গোপাল ২০১১ সালে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে শাসকদলের ছত্রছায়ায় এলাকায় তোলাবাজি শুরু করেছে জানা সত্ত্বেও তাকে ধরার ব্যপারে তৎপর হয়নি লাললবাজার। যার ফলে গোপাল ও তার শাগরেদরা মিলে খুব সহজেই মজুদ করেছিল অস্ত্র-বোমা। যার মধ্যে ছিল নাইন এবং সেভেন এমএমের মতো উন্নত অস্ত্রও। কলকাতা পুরভোটের দিন যার একটি দিয়ে গুলি করা হয় সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে।
পুলিশ সূত্রের খবর, বৈঠকে সিপি তাঁর অফিসারদের বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে আরও জোর দিতে বলেছেন। লালবাজার সূত্রের খবর, মে মাসে কলকাতা পুলিশের ৬৯টি থানা এলাকায় মাত্র ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উত্তর বিভাগের কোনও থানাই ওই মাসে কোনও বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করেনি। লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘গত বারের ক্রাইম বৈঠকেও সিপি বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করার কথা বলেছিলেন। তাতে যে তেমন কাজ হয়নি, মে মাসের বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান থেকে তা পরিষ্কার।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, এত কম পরিমাণ বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হওয়াতেই হয়তো এ দিনের বৈঠকে অফিসারদের সামনে ফের প্রসঙ্গটি তোলেন সিপি। ছোট ঘটনা বলে কোনও ঘটনাকেই উপেক্ষা না করার কথাও তখনই বলেন তিনি। সিপির এ দিনের ওই বক্তব্যের আগে, শহরে বেআইনি অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে ওঠা নিয়ে সরব হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশেরই একাংশ। তাঁদের অভিযোগ ছিল, কলকাতা পুর-ভোটের আগে থেকেই শহরে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে তল্লাশি চালানো কার্যত বন্ধ করে দেয় পুলিশ। বন্ধ হয়ে যায় পরিচিত দুষ্কৃতীদের ধরার অভিযানও। যার জেরেই শহরে একের পর এক জায়গায় গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের নিচুতলার ওই অংশের অভিযোগ।
কলকাতা পুলিশে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া এক আইপিএস অফিসারের কথায়, ‘‘প্রতি বার ভোটের আগে লালবাজার থেকে প্রতিটি থানা এবং গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখাকে বেআইনি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এ বার তা হয়নি বলেই শহরে পরপর গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। যাতে পুলিশ অফিসারকেও গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে।’’
বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করা নিয়ে পুলিশ কমিশনারের এই কথার অবশ্য ভিন্ন মানে খুঁজে পেয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করা ভাল, কিন্তু এত বেআইনি অস্ত্র এল কোথা থেকে? আসলে এটা ভোটের প্রস্তুতি, যাতে শাসকদলের কর্মীদের বলা হচ্ছে সব অস্ত্র লুকিয়ে ফেলতে।’’ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের কথায়, ‘‘বিধানসভা ভোটের আগে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের নামে বিরোধী দলের কর্মীদের ফাঁসানোর চক্রান্ত করা হচ্ছে।’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য পুলিশ কমিশনারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘‘কমিশনার যদি সত্যি বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে চান, তা হলে তাঁকে তল্লাশি চালাতে হবে শাসকদলের কর্মীদের বিরুদ্ধেই। কারণ এখন সকল দুষ্কৃতীই রয়েছে শাসকদলের ছত্রছায়ায়। যা তিনি পারবেন না।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, গত মে মাসে এন্টালি থানা এলাকায় গুলি চালানোর প্রথম ঘটনাটি ঘটে। আতঙ্কিত মানুষকে এ-দিক ওদিক ছুটোছুটি করতে দেখা গিয়েছিল সে দিন। তার পরেই ২৭ এবং ২৮ মে রাতে পরপর দুই রাতে গুলি চলে পার্ক স্ট্রিটের কলিন্স লেনে। ওই ঘটনার কয়েক দিন আগেই তিলজলা থানা এলাকার একটি ফ্ল্যাটে মজুত রাখা বোমা ফেটে যায়। আহত হয় এক দুষ্কৃতী। তার আগে পুরভোটের দিনে মধ্য কলকাতার কুখ্যাত দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারি ও তার দলবলের হাতে গুলিবিদ্ধ হন কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল। পরে গোপালের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বিপুল অস্ত্র-বোমা। পরপর এ ভাবে বোমা-গুলি চলার ঘটনাতেই শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। কেন গোপালের বাড়িতে রাখা বেআইনি অস্ত্র কিংবা ফ্ল্যাটে বোমা মজুতের খবর পুলিশ আগে পেল না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন পুলিশের নিচুতলার কর্মীরা।
নিচুতলার ওই অংশের দাবি, অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই লালবাজারের কর্তারা আগে থেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। পুলিশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, কলিন্স লেনে প্রথম দিন এক রাউন্ড গুলি চালানোর পর তাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি পার্ক স্ট্রিট থানা। যার ফলে ওই ঘটনার পরদিনই ফের গুলি চালানোর ঘটনায় আহত হন এক ব্যক্তি। তেমনই একবালপুরেও একটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি পুলিশ। পরে ওই ঘটনা বড় আকার নেয়, মারা যান এক মহিলা।
এ সবের পাশাপাশি এ দিনের বৈঠকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাতর্ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তায় হেস্টিংস থানাকে টহলদারি বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন সিপি। গত মাসেই পরপর দু’দিন ভিক্টোরিয়ার সামনে লুটেরাদের কবলে পড়েছিলেন দুই প্রাতর্ভ্রমণকারী। পুলিশের একাংশের অনুমান, ওই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতেই সিপি এ দিন টহলদারি বাড়াতে বলেন। সেই সঙ্গে এ দিনের বৈঠকে শহরে মোটরবাইক চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়াতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন পুলিশ কমিশনার। এপ্রিল মাসে কোনও লুঠের ঘটনা না ঘটলেও মে মাসে এমন তিনটি ঘটনা ঘটেছে।
লালবাজার সূত্রের খবর, সোমবারের বৈঠকে কমিশনার দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু করতেও বলেছেন থানাগুলিকে। এক অফিসার বলেন, ‘‘সিপি আমাদের বলেছেন বড় বড় পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে এখন থেকেই বৈঠক করতে, যাতে পুজোর সময় কোনও ধরনের সমস্যা না হয়। সেই সঙ্গে পুজো কমিটিগুলি যাতে আইন মেনে পুজো করে, তা-ও নিশ্চিত করতে বলেছেন তিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy