Advertisement
০৪ মে ২০২৪
পণ্ডিতিয়া-তাণ্ডব ১

স্কুটির দোষে কি দুর্ঘটনা, মিলছে ‘তথ্য’

তফাত শুধু একটি অক্ষরে। জি আর বি। তাতেই সূত্রপাত ঘাতক গাড়িটিকে নিয়ে বিভ্রান্তির। আর তার জেরেই পণ্ডিতিয়া টেরাসের ফোর্ট ওয়েসিস আবাসনে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর চালানো হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহ পুলিশের একাংশের।

সেই মার্সিডিজ। — নিজস্ব চিত্র

সেই মার্সিডিজ। — নিজস্ব চিত্র

তিয়াষ মুখোপাধ্যায় ও শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:১০
Share: Save:

তফাত শুধু একটি অক্ষরে। জি আর বি। তাতেই সূত্রপাত ঘাতক গাড়িটিকে নিয়ে বিভ্রান্তির। আর তার জেরেই পণ্ডিতিয়া টেরাসের ফোর্ট ওয়েসিস আবাসনে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর চালানো হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহ পুলিশের একাংশের।

পুলিশের একটি সূত্রের খবর, ঘাতক স্টিল গ্রে মার্সিডিজ গাড়িটির নম্বর ডব্লিউবি ০২/এজি ৬৯১১। যেখানে ফোর্ট ওয়েসিস আবাসনের লাল রঙের একটি সুইফ্‌ট গাড়ির নম্বর ডব্লিউবি ০২/এবি ৬৯১১। আর এই নম্বরের মিল খুঁজে পেয়েই দুর্ঘটনার সূত্র ধরে লাগোয়া তেঁতুলতলা বস্তির বাসিন্দারা আবাসনে ভাঙচুর চালায় বলে তদন্তকারীদের অনেকের ধারণা।

শনিবার রাতে হাজরা রোডের পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু হয়, জখম হন দুই যুবক। পুলিশের একাধিক সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করা কয়েক জনের বক্তব্য, গাড়িটি মোটামুটি ঠিকই যাচ্ছিল। হঠাৎই চালক-সহ তিন আরোহীকে নিয়ে একটি স্কুটি রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত গতিতে বাঁক নিতে যায়। আরোহীদের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। আচমকা বাঁক নিতে যাওয়া স্কুটিতে সোজা ধাক্কা মারে মার্সিডিজটি। লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘মার্সিডিজটি সঠিক দিকে যাচ্ছিল বলে এমনিতেই গতি বেশি ছিল। এ দিকে, একেই স্কুটিটির আরোহী ছিলেন তিন জন ও অত রাতে রাস্তা ফাঁকা থাকে ধরে নিয়ে এক দিক থেকে অন্য দিকে যাওয়ার সময়ে হয়তো তাঁরা সে ভাবে খেয়াল করার প্রয়োজন মনে করেননি। মনে হচ্ছে দুর্ঘটনার এটিই কারণ।’’ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের কেউ নেশাগ্রস্ত ছিলেন বলে এখনও পুলিশের কাছে কোনও তথ্য নেই। অন্য দিকে, তিন দিন পেরিয়ে গেলেও দুর্ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। খোঁজ মেলেনি গাড়ির সওয়ারিদেরও।

দুর্ঘটনার জেরে পণ্ডিতিয়ার ওই আবাসনে হামলার পরে বারবারই প্রশ্ন উঠেছিল, ঘাতক গাড়িটির সঙ্গে আবাসনের ঠিক কী সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন আক্রমণকারীরা। যেখানে গাড়িটি ওই আবাসনের কারও নয়! আবাসনের এক সুইফ্‌ট গাড়ির নম্বরের এই তথ্য পেয়ে তদন্তকারীরা মনে করছেন, হামলার কারণ খুঁজে বার করতে হয়তো কিছুটা এগোনো যাবে।

ঘাতক গাড়িটি নিয়ে তৈরি হয়েছে আরও একটি প্রশ্ন। গাড়ির চালক বা আরোহী কেউই যে ওই আবাসনের বাসিন্দা নন, এ কথা নিশ্চিত করেছেন আবাসন কর্তৃপক্ষই। অথচ দুর্ঘটনার পরে গাড়িটি থেকে ওই আবাসনের একটি ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণের বিল মিলেছে। তবে যাঁর নামে বিল, তাঁর সঙ্গে গাড়িটির কোনও সম্পর্কই নেই বলে আবাসন ও পুলিশ সূত্রে খবর। গাড়িটি ওই আবাসনের না হলে বিলটি কী ভাবে গাড়ির ভিতরে পাওয়া গেল প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

তার ভিতর থেকে পাওয়া কাগজ যাতে পণ্ডিতিয়ার ওই আবাসনের ঠিকানা মেলে।

শনিবার রাতে দুর্ঘটনাটি দেখেছেন বলে দাবি করেছেন বেনেপাড়ার ২৭ বছরের যুবক সমীর প্রসাদ। মঙ্গলবার তিনি জানান, স্কুটি নিয়ে রাস্তার এক পাশ থেকে আর এক পাশে যাওয়ার সময়ে পিছন থেকে এসে ধাক্কা মারে মার্সিডিজটি। স্কুটির তিন আরোহীর মাথায় হেলমেট ছিল না। ওই তিন জনের মধ্যে এক জন তাঁর পরিচিত। তবে সেই বন্ধুর নাম বলতে পারেননি সমীর। তিনি জানান, মার্সিডিজটি স্কুটিটিকে ধাক্কা মারার পরে তিন আরোহী ছিটকে পড়েন রাস্তায়। স্কুটিটিকে ছেঁচড়ে মহারাষ্ট্র নিবাস পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে থামে গাড়িটি। তবে গাড়িতে কত জন ছিলেন, দুর্ঘটনার পরেই বা তাঁরা কী করলেন, তা দেখেননি বলেই দাবি সমীরের। আর এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, দুর্ঘটনার পরে এক যুবক মার্সিডি়জ থেকে নেমে মোবাইলে ফোন করে অন্য একটি গাড়ি ডাকে। তাতে করেই তল্লাট ছাড়েন ঘাতক গাড়ির চালক ও আরোহীরা।

তদন্তকারীদের অনুমান, গাড়িটির মালিকের পরিবারের সকলে এখন একসঙ্গে নেই। দুর্ঘটনার পরেই তাঁরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশের বক্তব্য, ঘটনার পর পরই মার্সিডিজের মালিক ও চালক কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। পুলিশের দাবি, ওই দিন গাড়ির মালিকের ছেলের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়চক। পরে ওই দিনই আবার তাঁর টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যায় হাওড়ার দেউলটিতে। এর পর থেকেই মোবাইলটি বন্ধ। একই দিনে পর পর এই দু’জায়গায় অবস্থান থেকে পুলিশের সন্দেহ, রায়চক থেকে ওই যুবক নদী পেরিয়ে জলপথে দেউলটি চলে গিয়েছেন।

লালবাজার সূত্রের খবর, সোমবার অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের ছেলে অন্য একটি মোবাইল থেকে তাঁর দুই বন্ধুকে ফোন করেছিলেন, যাঁদের মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের তদন্তকারীরা। পুলিশ জানিয়েছে, টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই দুই বন্ধুকে ফোন করেছিলেন তিনি। তবে কোথা থেকে ফোনটি এসেছিল তা জানাতে চাননি গোয়েন্দারা।

এত তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন অভিযুক্তকে ধরতে পারছে না পুলিশ, সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। পুলিশের নিচু তলার একাংশের অভিযোগ, ঘটনার পরে প্রাথমিক ভাবে তদন্তভার ছিল টালিগঞ্জ থানার হাতে। পরে রবিবার সকালে নিয়ম মতো ওই থানা থেকে তদন্তভার নেয় লালবাজারের ট্রাফিক বিভাগ। পুলিশের অন্দরেই অভিযোগ, তদন্তে নেমে সময় মতো পদক্ষেপ করতে বিলম্বের সুযোগ নিয়েই কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন অভিযুক্তেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE