Advertisement
১৮ মে ২০২৪
book review

এক বিপুল সৃষ্টি সমুদ্রের পরিচয়

এই সঙ্কলনে সাধারণ ভাবে পুরাণের পরিচয় যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন প্রধান ও অপ্রধান পুরাণ সম্পর্কে পৃথক ভাবেও আলোচনা পাওয়া যায়।

Picture of mythology.

কিরাতার্জুনীয়ম্‌: কিরাতরূপী শিবের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ, মহাদেব পাশুপত অস্ত্র দিচ্ছেন অর্জুনকে। রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

সত্যবতী গিরি
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১৪
Share: Save:

সংস্কৃত সাহিত্য কোশ

সুভাষ ভট্টাচার্য

১১০০.০০

কারিগর

অভিধানচর্চার ক্ষেত্রে প্রবীণ গবেষক সুভাষ ভট্টাচার্যের নাম সুপরিচিত। একক প্রচেষ্টায় তিনি সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছেন দশ-বারোটি অভিধান। তাঁর পঞ্চাশ বছরের অভিধানচর্চায় এ বার যুক্ত হল সংস্কৃত সাহিত্য কোশ।

অভিধান ও কোশগ্রন্থ যে কোনও জিজ্ঞাসু পাঠকের কাছেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এদের মধ্যে সাদৃশ্য যেমন আছে, তেমনই কিছুটা পার্থক্যও আছে। অভিধানে বিভিন্ন ধরনের শব্দের ব্যুৎপত্তি, উৎস ও সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়, কোশগ্রন্থে সাধারণত বিশেষ গ্রন্থ, ব্যক্তি ও বিষয় সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে পারম্পর্যবিহীন ভাবে ইংরেজি ভাষার কয়েকটি কোশগ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়, যেমন জন ডাউসন সঙ্কলিত ক্লাসিক্যাল ডিকশনারি অব হিন্দু মিথলজি, জে এন ভট্টাচার্য ও নীলাঞ্জনা সরকার সঙ্কলিত এনসাইক্লোপেডিক ডিকশনারি অব স্যান্সক্রিট লিটারেচার, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আ কম্প্যানিয়ন অব স্যান্সক্রিট লিটারেচার ইত্যাদি।

সংস্কৃত ভাষায় অমরকোষ একটি বিখ্যাত প্রাচীন অভিধানগ্রন্থ। প্রাচীনতম সংস্কৃত কোশগ্রন্থগুলির অন্যতম। আরও এক অভিনব কোশগ্রন্থ হল সুভাষিত রত্ন-ভাণ্ডাগার। এখানে দশ হাজার সুভাষিতের সঙ্কলন আছে। তার বিষয়বস্তুও বিচিত্র, যেমন মঙ্গলাচরণপ্রকরণম্, সামান্যপ্রকরণম্, রাজপ্রকরণম্, চিত্রপ্রকরণম্, অন্যোক্তিপ্রকরণম্, নবরসপ্রকরণম্, সঙ্কীর্ণপ্রকরণম্। অবশ্য এই গ্রন্থের প্রকৃতি কিঞ্চিৎ পৃথক। এখানে গবেষক ও সাধারণ পাঠকের অন্বেষণের নিবৃত্তি ঘটে। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় এই ধরনের কোশগ্রন্থ আরও পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষায় রচিত একটি অসামান্য কোশগ্রন্থ হল চারটি খণ্ডে বিভক্ত বৃহদায়তন বৈষ্ণব অভিধান। হরিদাস দাস সঙ্কলিত প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব গ্রন্থে ব্যবহৃত সংস্কৃত, তৎসম, তদ্ভব ও অন্য শব্দাবলির আকর অর্থ যদিও তাৎপর্য নির্ণয় করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে হিন্দি-ব্রজবুলি-মৈথিলী-ওড়িয়া-বাংলা ভাষায় লেখা বৈষ্ণব পদাবলিতে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ নির্ণয় করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে আছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব গ্রন্থসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, সেই সঙ্গে এই গ্রন্থগুলির রচয়িতাদের ও সৃষ্ট চরিত্রগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। চতুর্থ খণ্ডে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থ, শ্রীপাট ও অন্যান্য স্থানের পরিচিতি এবং বৈষ্ণবদের উৎসবগুলির বিস্তৃত বিবরণ। দেখা যাচ্ছে, বৈষ্ণব সাহিত্য বিষয়ে গবেষণায় এই কোশগ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য।

বাংলা ভাষায় একাধিক পৌরাণিক অভিধান আছে, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর পুরাণকোষ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাংলা ভাষায় প্রথম সংস্কৃত সাহিত্যকোশ হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে এক বিশেষ জায়গা দাবি করতে পারে। এই গ্রন্থে গ্রন্থ-পরিচয়, রচয়িতার পরিচয়, উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক চরিত্রের পরিচয় আর সেই সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয়ও পাওয়া যাচ্ছে। দেবযানী, দুর্বাসা, দ্রুপদ, এ ধরনের পরিচিত চরিত্রগুলির পাশাপাশি স্বল্পপরিচিত বা একেবারে অপরিচিত চরিত্র, গ্রন্থের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন সঙ্কলক। যেমন, অপ্সরা পুঞ্জিকাস্থলা। তবে এই অপ্সরার পরিচয় দেওয়া হলেও চরিত্রটির উৎস সম্পর্কে সঙ্কলক কিছু জানাননি। এ ধরনের চরিত্র ছাড়াও টেক্সটেরও নাম করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম নবম শতকে জিন সেনের সৃষ্টি পার্শ্বাভ্যুদয়। আবার অনেক পরিচিত গ্রন্থেরও সময় বলা নেই— এগুলির মধ্যে আছে স্মৃতিগ্রন্থ কালবিবেক, কিরাতার্জুনীয়ম্, কুন্দমালা ইত্যাদি।

কিছু কিছু গ্রন্থের সুস্পষ্ট পরিচয় পাঠককে সমৃদ্ধ করে, যেমন দণ্ডনীতি। রাজতন্ত্রে দণ্ডদানের বৈচিত্রের মোটামুটি বিস্তৃত আলোচনা খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু বিষয় দণ্ডনীতির মতোই এখনও সমান প্রাসঙ্গিক, নিঃসন্তান পিতামাতার দত্তক সন্তান গ্রহণ এমনই এক বিষয়। এ ধরনের দু’টি স্মৃতিগ্রন্থের পরিচয় এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট, দত্তকচন্দ্রিকা ও দত্তকমীমাংসা।

এই সঙ্কলনে সাধারণ ভাবে পুরাণের পরিচয় যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন প্রধান ও অপ্রধান পুরাণ সম্পর্কে পৃথক ভাবেও আলোচনা পাওয়া যায়। বহু প্রাচীন গ্রন্থের পাশাপাশি পরবর্তী সময়ের নানা গ্রন্থ ও লেখকের পরিচয়ও এখানে পাওয়া যায়। মহাভারতের কাল এই গ্রন্থে আলোচিত, পাশাপাশি জীব গোস্বামী, রূপ গোস্বামীর গ্রন্থের উল্লেখও একে সমৃদ্ধ করেছে। যে বিভিন্ন প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থ পরবর্তী আইন ব্যবসাতেও গৃহীত হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে মিতাক্ষরা অন্যতম। এই কোশগ্রন্থে মিতাক্ষরা-র পরিচয় মোটামুটি বিস্তৃত ভাবেই দেওয়া হয়েছে।

শুধু ষোড়শ শতাব্দী নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রাধাকান্ত দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় শব্দকল্পদ্রুম নামে যে কোশগ্রন্থটি সঙ্কলিত হয়েছিল, সাত খণ্ডের সেই গ্রন্থ সম্পর্কেও মোটামুটি জ্ঞাতব্য তথ্য এখানে পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত কালপরিসরে প্রকাশিত এই কোশগ্রন্থে শুধু শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি অর্থ, সমার্থক শব্দ বা প্রতিশব্দই নেই, যে সব গ্রন্থে এই শব্দগুলির প্রয়োগ আছে সেই সম্পর্কিত তথ্যও রয়েছে। বর্তমান সঙ্কলনের কোশগ্রন্থে আধুনিক যুগের এই গ্রন্থটি ছাড়াও শব্দকৌস্তুভ, শব্দমণি দীধিতি, শব্দানুশাসন, শব্দার্ণব চন্দ্রিকা ইত্যাদি প্রাচীন শব্দকোশ গ্রন্থের পরিচয়ও এখানে আমরা পাচ্ছি। এই কোশগ্রন্থে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য নির্মাণ অর্থাৎ কারিগরি বিদ্যা সংক্রান্ত শিল্পরত্ন ও শিল্পশাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থের পরিচয় পাচ্ছি।

গ্রন্থের ভূমিকাটিও অত্যন্ত মূল্যবান। সঙ্কলক প্রথমেই বলে দিয়েছেন কোশগ্রন্থে সঙ্কলিত বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রন্থ ও চরিত্রের কথা। বিষয়গুলির ব্যাপ্তি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। কোশগ্রন্থে সঙ্কলিত বিষয় কুড়িটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে বৈদিক সাহিত্য অর্থাৎ বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, বেদাঙ্গ, কল্প, নিরুক্ত ইত্যাদির পরিচয়। দ্বিতীয় ভাগে মহাকাব্যের পরিচয়। তৃতীয় মহাপুরাণ ও উলটপুরাণ, চতুর্থ তন্ত্রশাস্ত্র, পঞ্চম ব্যাকরণ ও অভিধান, ষষ্ঠ নাটক, সপ্তম কাব্য ও গীতিকাব্য, অষ্টম ভাগে আছে চম্পূ-সাহিত্য, নবম ভাগে গদ্য সাহিত্য, আছে আইন ও স্মৃতিশাস্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, কামশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, নৃত্যকলা, সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধ রচনা এবং ছন্দ-শাস্ত্র ইত্যাদি। এই বিপুল ও বিচিত্র বিষয়ের সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্কলক আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন। কিন্তু ভূমিকায় বিষয়বস্তুর বিভাজন করলেও গ্রন্থের মধ্যে বর্ণানুক্রমিক ভাবেই বিষয়ের কথা রয়েছে। মনে হয়, এ ক্ষেত্রে বিষয় অনুযায়ী বিভিন্ন অধ্যায়ে গ্রন্থের বিভাজন করা হলে পাঠক অনেক সহজে এই কোশগ্রন্থ ব্যবহার করতে পারতেন।

প্রাক্‌কথনে সঙ্কলক বলেছেন ১৭৮৬ সালে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে উইলিয়াম জোনস-এর একটি বক্তৃতার কথা। সেখানে তিনি সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃত ভাষার উৎস ও প্রথম বৈদিক সাহিত্যের নিদর্শন ঋগ্বেদ-এরও উল্লেখ করেছেন। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, লোকাচার প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ের গ্রন্থ যে সংস্কৃত ভাষাতে রচিত হয়েছে, তা নিয়েও তিনি সচেতন করেন।

এই কোশগ্রন্থে ভুক্তি বা মুখ শব্দের আলোচনা কোন পদ্ধতিতে করা হবে সে সম্পর্কেও ভূমিকায় তিনি পাঠকদের স্পষ্ট ধারণা তৈরি করে দিয়েছেন। যদি কাব্য সম্পর্কে আলোচনা হয় তা হলে কাব্যের বিষয়, ব্যবহৃত ছন্দ, কাব্যের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য গুণের কথা বলা হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথমেই দেওয়া হবে পরিচয়, সময় নির্ণয় করা হবে, তার লেখা গ্রন্থ-উল্লেখের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও থাকবে। কিন্তু সঙ্কলক এই দাবি করলেও কখনও-কখনও বহু গ্রন্থরচয়িতা লেখকদের সমগ্র সৃষ্টির উল্লেখ সঙ্কলকের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের অন্যতম নির্মাতা জীব গোস্বামীর প্রধান গ্রন্থ ষট্ সন্দর্ভ-এর উল্লেখ এই গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও সনাতন গোস্বামীর আলোচনায় তাঁর বৃহৎভাগবতামৃত ও ভাগবতের বৈষ্ণব তোষিণী টীকার অনুল্লেখও কিছুটা বিস্মিত করে। তবু বলা যায়, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার যে বিপুল সৃষ্টিসমুদ্রের পরিচয় তিনি এই গ্রন্থে রেখেছেন তার প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও কার্যকারিতা অপরিসীম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review Bengali book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE