Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মূল অভিযুক্তরা এখনও অধরাই

থমথমে বুঁদড়ায় ফিরল তৃণমূল কর্মীর দেহ

ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরেও জড়তা কাটেনি বুঁদড়ার। রংয়ের উত্‌সবে মেতে ওঠা দূর অস্ত, একটা চাপা উদ্বেগ গ্রাস করেছে গ্রামবাসীদের। ময়না-তদন্তের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলাইকুণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বুঁদড়া গ্রামে এসে পৌঁছয় মৃত তৃণমূল কর্মী প্রবোধ পাত্রের দেহ। স্বামীর মৃত্যুতে দিশাহারা প্রবোধবাবুর স্ত্রী আরতিদেবী। তাঁর কথায়, “গ্রামে অশান্তি চলছিল। ওইদিন উনি না বলেই হঠাত্‌ বাড়ি থেকে চলে গেলেন। তার পর ছুটে গিয়ে দেখি, চারিদিকে শুধু রক্ত। ছেলেরা কিছু করেনা। আমার সংসারটা ভেসে গেল।”

শোকার্ত নিহতের পরিজনেরা। —নিজস্ব চিত্র।

শোকার্ত নিহতের পরিজনেরা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৯
Share: Save:

ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরেও জড়তা কাটেনি বুঁদড়ার। রংয়ের উত্‌সবে মেতে ওঠা দূর অস্ত, একটা চাপা উদ্বেগ গ্রাস করেছে গ্রামবাসীদের। ময়না-তদন্তের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলাইকুণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বুঁদড়া গ্রামে এসে পৌঁছয় মৃত তৃণমূল কর্মী প্রবোধ পাত্রের দেহ। স্বামীর মৃত্যুতে দিশাহারা প্রবোধবাবুর স্ত্রী আরতিদেবী। তাঁর কথায়, “গ্রামে অশান্তি চলছিল। ওইদিন উনি না বলেই হঠাত্‌ বাড়ি থেকে চলে গেলেন। তার পর ছুটে গিয়ে দেখি, চারিদিকে শুধু রক্ত। ছেলেরা কিছু করেনা। আমার সংসারটা ভেসে গেল।”

এলাকায় শাসক দলের প্রবল উপস্থিতি। পঞ্চায়েতেও তাদেরই দখলে। কিন্তু বুধবার রাতে বুঁদড়া গ্রামে সিপিআইয়ের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ গেল এক তৃণমূল কর্মীর। জখম হন দু’পক্ষের আট জন। পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষের পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান প্রবোধ পাত্র (৬৫)। বৃহস্পতিবার সকালে খড়্গপুর গ্রামীণ থানায় তৃণমূলের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬ জন গ্রেফতার হন। স্থানীয় সূত্রের খবর, ধৃতেরা এলাকায় বাম কর্মী-সমর্থক বলে পরিচিত। মেদিনীপুর আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক ছ’জনকে ছ’দিন পুলিশ-হেফাজতে এবং বাকিদের ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। যদিও শুক্রবারও ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সিপিআই সমর্থক মাধাই চাউলিয়ার তিন ছেলেকে গ্রেফতার করা যায়নি। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “তৃণমূল কোনও দল নয়। করতগুলি উচ্ছৃঙ্খল মানুষের জটলা।”

কলাইকুণ্ডা পঞ্চায়েতের খুব কাছেই নিমপুরা-কলাইকুণ্ডা শিল্পতালুক। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সিপিআই প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র প্রভাব রয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে এবং পরে বেশ কিছু সিপিআই সমর্থক কলাইকুণ্ডা পঞ্চায়েত এলাকা ছেড়েছিলেন। পরে এলাকায় ফিরলেও তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের সঙ্গে তাঁদের ছোটখাটো মতবিরোধ লেগেইছিল। মাস তিনেক ধরে এলাকায় সরকারি জমিতে বাম-আমলের পাট্টাদারদের জোর করে দখল ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ উঠছিল তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বামেরা তা নিয়ে মাস তিনেক আগে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জমা দেন। মহকুমাশাসক (খড়্গপুর) সঞ্জয় ভট্টাচার্য জানান, ভূমি সংস্কার দফতর অভিযোগটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে বুঁদড়া গ্রামের একটি পুকুর কাটা নিয়ে গোলমাল শুরু হয় দু’পক্ষের। ১০০ দিনের প্রকল্পে ওই পুকুরের মাটি কাটতে গিয়ে বিধি না মেনে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বুধবারই বামেরা অভিযোগ জানান কলাইকুণ্ডা পঞ্চায়েতের কাছে। অভিযোগ মানেননি তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা। তাঁদের পাল্টা দাবি, বুধবার রাত ৯টা নাগাদ মোটরবাইকে চেপে বাড়ি ফেরার সময় বুঁদড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে অরূপ কারক নামে এক তৃণমূল কর্মীর পথ আটকান সিপিআই কর্মী-সমর্থকেরা। পুকুর কাটার বিষয় নিয়ে দু’পক্ষে বচসা শুরু হয়। অরূপবাবুর অভিযোগ, “সিপিআই কর্মী বলে পরিচিত তিন ভাই প্রকাশ, প্রসাদ ও বিকাশ চাউলিয়া আমাকে মারধর করে।” সেই সময় কোনওমতে সেখান থেকে পালিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন বলে অরূপবাবুর দাবি।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘটনা চাউর হতেই রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ এলাকার তৃণমূল কর্মীদের একাংশ চাউলিয়া পরিবারের বাড়ি ঘিরে ফেলে। কিন্তু সেই সময়ে ওই বাড়ি এবং আশপাশের বাড়ি থেকে বাম সমর্থক পরিবারের বাসিন্দারা বেরিয়ে আসেন। সংঘর্ষ বাধে। তৃণমূলের অভিযোগ, সিপিআইয়ের লোকেরা টাঙ্গির কোপ মারে প্রবোধবাবুর গলায়। নিহত বৃদ্ধের ছেলে কচি পাত্র বলেন, “গণ্ডগোল হয়েছে শুনে বাবা গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। তার পরে শুনি, এই কাণ্ড!”

বৃহস্পতিবার সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক সন্তোষ রানা বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে কালকে শাসক দলের লোকেরাই আমাদের লোকেদের উপরে হামলা করার মতলবে জড়ো হয়েছিল। তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খোলাটাই ওদের রাগের কারণ।” অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষ। এ দিন বুঁদরা গ্রামে নিহতের বাড়িতে গিয়ে তিনি বলেন, “এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণে বামেরা ফের খুনের রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছে। সে জন্য আমাদের এক কর্মীর প্রাণ গেল!”

নিজেদের আড়াই বিঘা জমিতেই চাষবাস ও লোকের জমিতে ভাগ চাষ করে কোনও রকমে সংসার চালাতেন প্রবোধবাবু বড় ছেলে গৌতম ওরফে কচি ও ছোট ছেলে উত্তম। গৌতম পাত্রের কথায়, “বাবার দেখানো পথে আমরা চাষের কাজ করতাম। কোনওভাবে সংসারটা চলে যেত। ছোট ভাইয়ের শরীর ভাল নয়। তাই ভারি কাজ করতে পারে না। একটা অশান্তিতে আমাদের জীবনটা চুড়মার হয়ে গেল।” তিনি আরও বলেন, “বাবার মৃত্যুর পরে এখনও পর্যন্ত কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তবে নির্মলবাবু (নির্মল ঘোষ) আমার ছোটভাইকে চাষের কাজে সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। সেই সাহায্য পেলে ভাল হয়।”

সিপিআই সমর্থক স্বামী মাধাই চাউলিয়াকে পুলিশ আটক করেছে। তিন ছেলেও বাড়িতে নেই। ভেঙে পড়েছেন মাধাইবাবুর স্ত্রী মল্লিকা চাউলিয়াও। তাঁর কথায়, “আমরা কোনওদিন কোনও অশান্তিতে যাইনি। গ্রামে কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, বুঝতে পারছি না। আজ সকালে আমি বাড়িতে এসেছি। বাড়ির সামনে পুলিশ আছে তবুও ভয় লাগছে।” বাড়িতে নেই ঘটনায় অভিযুক্ত কালু সিংহ, প্রফুল্ল সিংহ, অঞ্জন পাহাড়ি, পাশের গ্রাম গুমরিয়াপালের অরুণ গিরিদের মতো বাম কর্মী-সমর্থকেরাও। সিপিআই রাজ্য কমিটির সদস্য বিপ্লব ভট্ট বলেন, “বুঁদড়া গ্রামে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার জেরে আমাদের অনেককেই ঘরছাড়া হতে হয়েছে। আর যাঁরা আছে তাঁদের রাস্তায় ধরে মারধর করছে তৃণমূল। পুলিশে বিষয়টি জানিয়েছি।”

শুক্রবার অরূপ কারককে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ দিন প্রাক্তন কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্য নিতাই কারক বলেন, “মাধাইবাবুদের বাড়িতে সম্যসার মীমাংসার জন্য গিয়েছিলাম। সে দিন গ্রামবাসীরা ও মাধাইবাবুর পরিবারের লোকেরা যে ভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তাতে আমি না থাকলে আরও অনেকের প্রাণ যেত।” পুলিশ জানিয়েছে, পুলিশ হেফাজতে থাকা ছ’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। এলাকায় পুলিশ পিকেটও রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kharagpur tmc pabodh patra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE