সোমবার নহরিয়া গ্রামে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও ঝাড়গ্রামের এসপি। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
কোনও ভয় নেই। কেউ হুমকি-চাপ দিচ্ছে না। সবাই ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। এক সময়ের মাওবাদী সন্ত্রাস কবলিত ঝাড়গ্রামের নহরিয়া গ্রামে এসে বাসিন্দাদের মুখে এমনই কথা শুনলেন জেলাশাসক-পুলিশ সুপার। ভোটারদের আশ্বস্ত করতে সোমবার গোপীবল্লভপুর বিধানসভার অন্তর্গত ঝাড়গ্রাম ব্লকের নহরিয়া গ্রামে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা ও ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের তাঁরা প্রশ্ন করেন, কেউ ভয় দেখাচ্ছে? এলাকায় ভয়ভীতির পরিবেশ আছে? আচমকা প্রশাসন-পুলিশ কর্তাদের এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যান নরহিরার মধ্যমপল্লির বাসিন্দারা।
জঙ্গলমহলের অশান্তিপর্বের সময়ে এই গ্রামেই সশস্ত্র মাওবাদীদের ডেরা ছিল। এলাকার কিছু যুবককে দলে সামিল করেছিল মাওবাদীরা। এই গ্রামেই থাকতেন সিপিএমের লোধাশুলি লোকাল কমিটির সদস্য সুধাংশুশেখর মাইতি। ২০১০ সালের ৭ মে গভীর রাতে বাড়িতে চড়াও হয়ে সুধাংশুবাবুকে স্ত্রী-পরিজনদের সামনে গুলি করে খুন করেছিল মাওবাদীরা। সেই আতঙ্কের রেশ এখনও মোছেনি। এক সময় জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকা থেকে অপহৃত লোকজনকে নিয়ে এসে মাওবাদীরা গ্রামের লাগোয়া জঙ্গলে গণবিচার করত। শ্রেণি শত্রুদের হাত পিছমোড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো গভীর জঙ্গলে। রাত বিরেতে শোনা যেত মৃত্যুর আর্তনাদ।
রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে নহরিয়ার জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয়েছে একাধিক অপহৃতের কঙ্কাল। সেই গ্রামে অবশ্য এখন ‘শান্তির পরিবেশ’। গ্রামের রাস্তায় পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের টাকায় জলের কল হয়েছে। জল ভরছিলেন সুধাংশুবাবুর দাদা সুধীর মাইতি। রাস্তায় প্রৌঢ়কে দেখতে পেয়ে জেলাশাসক জানতে চান, কোনও ভয়ভীতি আছে কিনা। কাঁপা গলায় সুধীরবাবু জবাব দেন, ‘না, আমরা সবাই খুব ভাল আছি।’ নিহত সুধাংশুবাবুর বাড়ির দেওয়ালে জ্বলজ্বল তরছে তৃণমূল প্রার্থী চূড়ামণি মাহাতোকে ভোট দেওয়ার প্রচার লিখন। গোটা গ্রামে বিরোধীদের প্রচারের ছিঁটে ফোঁটাও নেই কোত্থাও।
সাত সকালেই প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় মোটরবাইকে করে টহল শুরু করেছিলেন লোধাশুলি সিআরপি ক্যাম্পের জনা তিরিশ সশস্ত্র জওয়ান। সকাল থেকে গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আনাগোনা দেখে কিছুটা ধন্দে ছিলেন নহরিয়াবাসী। এ দিন সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ মোরাম রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে গ্রামে ঢোকে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের ছ’টি গাড়ির কনভয়। ডিএম-এসপির দু’টি গাড়ি বাদে বাকি গাড়িতে ছিল সশস্ত্র পুলিশ। প্রথমেই গ্রামবাসী ছবি মান্নার কাছে জেলাশাসক জানতে চান বাড়িতে ভোটার ক’জন। ছবিদেবী জানান ভোটার চারজন। ছেলেরা এখনও সাবালক নয়। তাই তাদের নাম তোলা হয়নি। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন মুখে ছবিদেবীর প্রশ্ন, কী কারণে এসব জানতে চাইছেন! ততক্ষণে জেলাশাসক এগিয়ে গিয়ে গ্রামের বধূ পার্বতী রায় ও তাঁর নন ননদ রসনা রায়কে প্রশ্ন করেন, কেউ ভয় দেখাচ্ছে? ছেলেকে কোলে নিয়ে জড়সড়ো রসনাদেবী বলেন, “কই দেখিনি তেমন কিছু।”
গ্রামের বৃদ্ধা আশালতা দত্ত জেলাশাসকের কাছে ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “ভোট তো দেব। কিন্তু আমার এত বয়সেও বার্ধক্য ভাতা পেলাম না কেন?” ততক্ষণে সেখানে হাজির হয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য দ্বিজপদ মান্না। অপ্রস্তুত দ্বিজপদবাবু জানান, ওই বৃদ্ধার কাগজপত্রে কিছু সমস্যা আছে বলে ভাতা চালু করা যায়নি। টহল দিয়ে ফিরে যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। পঞ্চায়েত সদস্য দ্বিজপদ মান্নার দাবি, “মাওবাদীরা আর নেই। এখন আমাদের সরকারের উদ্যোগে কেবল উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন দেখে বিরোধীরাও আমাদের সমর্থন করছেন।”
নিঃস্তব্ধ গ্রামের রাস্তায় স্থানীয় এক প্রবীণ অবশ্য ফিসফিসিয়ে বলেন, “বুঝলেন তো কেমন শ্মশানের শান্তি। মাওবাদী-কমিটির লোকরাই তো এখন তৃণমূলের নেতা-জনপ্রতিনিধি। পরিবর্তনের ফলে ওরা এখন দিদির দলে। পঞ্চায়েতের সব উন্নয়ন তো ওরাই পাচ্ছে। আমরা যা ছিলাম তাই আছি। বলতে হচ্ছে, ভাল আছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy