আরও একটা বিজয় দিবসের মুখে কাঁটাতারের ওপর অঘ্রানের কুয়াশা জমে আছে।
চোখের কোণে শিশির, বড় করে শ্বাস নিলে হারানো পুকুরের জলজ ঘ্রান। একটু খুঁটিয়ে কান পাতলে ফট ফট স্টেনগানের অবিরল দাপাদাপি। আর সব শেষে সেই সোল্লাশ, মাথা নিচু করে জেনারেল অরোরার পাশে বসে নতমস্তক নিয়াজি।
তার পর? বুড়ো আঙুলে উঠোনের মাটি খুঁটে তোলার ফাঁকে অশ্বিনী কর্মকার বলছেন, ‘‘ওই যে বললেন, ফট ফট...এক টানা আওয়াজ আর ঝরা পাতার মতো টুর টুপ করে পড়ে মরে গেল আমাদের আস্ত পরিবারটা। এগারোটা লোক, ভাবতে পারেন!’’ সেই ছেলেবেলাটা এখনও ধরা আছে অশ্বিনীর। চাঁপাই নবাবগঞ্জের সেই বাড়িটাও মনে আছে তাঁর। আগুন, ধোঁয়া, কান্না, ভয়— সব কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, আজও।
মনে আছে তাঁরও। চাপড়ার মাধবপুরের চণ্ডী সরকার। বলছেন, ‘‘বেলা বাড়তেই খবরটা এসেছিল, পাশের হাদলা গ্রামে পাক সেনা হানা দিয়েছে। মারা গিয়েছে অনেক মানুষ। ছুটলাম ফরিদপুরের ভিটাকুশুলিয়া ছেড়ে, রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অজস্র লাশ। গুলিতে ঝাঁঝরা, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর সেই মৃতদেহ আঁকড়ে মানুষের কান্না। আত সহজে কি ভায়ের রক্তে রাঙা দেশটা ভোলা যায়!’’
খুব শান্ত গলায় জানাচ্ছেন, ষোলো ডিসেম্বরটা ঠিক মনে পড়ে যায় তাঁর। ফরাক্কার বিন্দুগ্রামের গ্রামীণ চিকিৎসক অশ্বিনীর সেই দেশ ছাড়ার দুপুরটা এখনও ঝলমল করছে— ‘‘গোপনে ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে অচেনা এক ঘাটে এলাম আমরা তার পর, নিঃসঙ্গ নৌকা খুলে ভেসে পড়লাম!’’
কিন্তু পাবনা জেলারই সেতুপাড়ার বাসিন্দা মনোজ সন্ন্যাসীর পালিয়ে আসাটা সহজ ছিল না। বলছেন, ‘‘খুব কাছ থেকে দেখেছি মৃত্যুকে। এখন মনে হয় আমার বন্ধুগুলো পটাপট প্রাণ দিল আর আমি পালিয়ে এলাম, ঠিক করিনি!’’
ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেতের ভিতরে লুকিয়ে পড়শি গ্রামে ঢুকে যখন খান সেনার উড়ন্ত বুলেটে মাথা নুইয়ে শেষতক আশ্রয় নিয়েছিলেন সাতবাড়িয়ার হাইস্কুলে। সে রাতেই গাজনা বিলের কোল ঘেঁষে গ্রাম ছেড়েছিলেন তাঁরা। আর ফেরা হয়নি। তবে, ডিসেম্বর পড়লেই ওই ১৬ তারিখের দিকে দমবন্ধ করে বসে থাকেন তিনি। বলছেন, ‘‘ওই তারিখটাই বাঁচিয়ে রেখেছে!’’ তার পর, নিশ্চুপে পেরিয়ে যায় বছর, কাঁটাতারের কোল থেকে কিঞ্চিৎ হীনম্মন্যতা নিয়ে দেখেন স্বাধীন ‘দ্যাশের মাটিতে ফরফর করি উড়ত্যাসে স্বাধীন বাংলাদ্যাশের সবুজ পতাকাডা’।
কৃতজ্ঞতা: আনন্দবাজার আর্কাইভস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy