অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
জৈষ্ঠ্যের রোদে পিচ গলছে। বাইরে তাকালে ঝিলমিল লেগে যাচ্ছে চোখে। জানলা খুললে গরম হাওয়ায় চোখমুখ ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। স্নান সেরে বৈঠকখানায় এসে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা। মাথার উপরে বনবন করে পাখা ঘুরছে। ডিসকভারি চ্যানেল তখন বরফে বরফে সাদা।
দুপুরের এই সময়টা বাড়িতেই থাকেন তিনি আর পরিচারিকা। মেয়ে বিচারক। আদালতে বেরিয়ে গেলেই বাড়িটা খাঁ খাঁ। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। সোফায় গা এলিয়ে বৃদ্ধার চোখ নতুন এলইডি স্ক্রিনে। নিজের মনেই বিড়বিড় করছেন বৃদ্ধা, ‘‘আহা, চোখ দু’টো জুড়িয়ে গেল গো। বরফের বদলে একটু ঠান্ডা হাওয়া যদি এখানে মিলত! কী বেয়াড়া গরম রে বাবা!’’
ঠিক সেই সময়ে— টুং....টাং! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফের একবার বেজে উঠল কলিং বেল। এই সময় আবার কে?
উঠে গিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিলেন বৃদ্ধা। বাইরে দুই যুবক দাঁড়িয়ে। এক গাল হেসে তাদের একজন বলল, “নমস্কার মাসিমা, আমরা টিভি কোম্পানি থেকে আসছি। আপনাদের টিভিতে নাকি সমস্যা হচ্ছে।”
বেশ অবাক হয়েই বৃদ্ধা বললেন, ‘‘কই, না তো! টিভি তো দিব্যি চলছে বাবা।”
যুবকটি সে কথা শুনতে নারাজ, ‘‘সে কি মাসিমা! আপনারাই তো কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে সমস্যার কথা জানিয়েছেন।’’
বৃদ্ধা বুঝতে পারছেন না তাঁর কী করণীয়। তিনি ভাবছেন, তাহলে কি তাঁর বিচারক মেয়ে কখনও ফোন করেছিলেন? চোখমুখ দেখে ছেলে দু’টি বুঝতে পারে, বৃদ্ধা তাদের ঠিক ভরসা করতে পারছেন না। এ বার দু’জনেই তাদের পরিচয়পত্র বের করে বলে, ‘‘মাসিমার কি এখনও আমাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে?’’
একটু লজ্জিত হন বৃদ্ধা। আহা রে! এই গরমে ছেলে দু’টি দীর্ঘ পথ উজিয়ে এসেছে তাঁদের টিভি ঠিক করতে। আর তাদেরই কি না তিনি সন্দেহ করছেন! একটু অপ্রস্তুত হয়ে তিনি বলেন, ‘‘না না, বাবা, অবিশ্বাস করব কেন! আসলে কী জানো তো, যত বয়স বাড়ছে তত ভয়ও বাড়ছে। দিনকাল তো ভাল নয়।’’
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ওই দুই যুবকদের একজন বলে, ‘‘তা যা বলেছেন মাসিমা! চুরি, কেপমারি, ডাকাতি এ সব তো লেগেই রয়েছে। খবরের কাগজ খুললেই চমকে উঠতে হচ্ছে।’’
ছেলে দু’টো টিভিটা নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল। বৃদ্ধা একমনে তাদের কাজ দেখছেন। বাড়ির পরিচারিকা ব্যস্ত রান্নাঘরে। এ বার একজন অনুরোধ করল, ‘‘মাসিমা, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। একটু জল খাওয়াবেন?’’
বৃদ্ধা আর একপ্রস্ত অস্বস্তিতে পড়েন। রোদে পুড়ে ছেলে দু’টি এসেছে। জলের কথাটা তাঁরই আগে বলা উচিত ছিল। তড়িঘড়ি তিনি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। ফিরে আসেন দু’গেলাস সরবত নিয়ে। বৃদ্ধা ফিরে এসে দেখেন, ঝকঝকে ছবি উধাও। ঝিলমিল করছে টিভির পর্দা।
সত্যিই কি তাহলে খারাপ হয়ে গিয়েছে নতুন কেনা টিভিটা? তিনি জানতে পারেননি? সেই কারণেই কি মেয়ে তাঁর অজান্তে ফোন করেছিল?
সরবতের গেলাসে চুমুক দিয়ে ছেলেটি বলে, ‘‘দেখলেন তো মাসিমা! টিভিতে ছোট্ট একটু গণ্ডগোল রয়েছে। তবে চিন্তা করবেন না। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এটা বদলে নতুন একটা টিভি দিয়ে যাব।’’
এ বার বৃদ্ধাকে সতর্ক করেন পরিচারিকা, ‘‘ও মাসি, লোকগুলোকে এতটা বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে তো? দিদিমনিকে একবার ফোন করো।’’ বৃদ্ধা মেয়েকে ফোন করলেন। এক বার, দু’ বার, তিন বার। রিং বেজেই গেল। এজলাসে থাকলে তাঁর মেয়ে যে ফোন ধরতে পারেন না।
কিন্তু এত দামি টিভিটা তিনি কি তুলে দেবেন অপরিচিত ছেলে দু’টোর হাতে? তারপর পরিচারিকাকে বললেন, ‘‘ওরে শোন, এত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে! ভরদুপুরে বিচারকের বাড়ি থেকে এ ভাবে কেউ টিভি তুলে নিয়ে পালায় নাকি?’’
কথাটা কি কানে গিয়েছিল ছেলে দু’টোর? তারা কি চোখ টিপে মুচকে হেসেছিল?
কপাল ঠুকে বৃদ্ধা ওই দু’জনের হাতে তুলে দিলেন এলইডি টিভিটা। হাসিমুখে তারা বেরিয়ে পড়ে। বাইরে দাঁড় করানো মোটরবাইক। একজন বাইক স্টার্ট দিল। অন্য জন টিভিটা নিয়ে গুছিয়ে বসল পিছনের সিটে। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা ও তাঁর পরিচারিকা।
বাইক ছোটানোর আগে একজন বলল, ‘‘চিন্তা করবেন না মাসিমা। এই যাব আর আসব।’’
বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ নামে। মেয়ে ফেরে, টিভি ফেরে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy