হাটুরেদের দখলদারি।— নিজস্ব চিত্র
কলা-মুলো, লঙ্কা-উচ্ছের পাশেই চটের উপর ধার না-ধরা কাস্তে-হাঁসুয়া। চাষের এটা-সেটা মামুলি সরঞ্জাম। কাঁচা হলুদ আর অসময়ের গুড়।
চার দশক ধরে প্রায় প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছোন হাটটা এখন আর গ্রামের বটতলা ঘিরে বসে না। বড়ঞা-বেলগ্রাম রাজ্য সড়কটা ঝকঝকে হয়ে ওঠার পরে সেই রাস্তাতেই উঠে এসেছে বড়ঞার হাটতলা।
দিনে দিনে গ্রামের চেহারাটাও বদলেছে। এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি গজিয়ে ওঠায় নিশ্চুপে নামটাও বদলে ফেলেছে, হাটতলা হয়েছে থানাকপাড়ার হাট।
আর, মাটি লেগে থাকা কাঁচা সব্জির সঙ্গেই রাজ্য সড়কের দখলদারি নেওয়া হাটটায় খোঁজ করলেই মিলছে, মোবাইলের সিম কার্ড, সস্তার ঘড়ি, ইলেকট্রিক লাইটার থেকে সস গোলা চাউমিন আর পোড়া পাঁপড়।
রাস্তার ঠিক মাঝখানে কাগজের থালায় সেই দশ টাকার এগ-চাউ খাওয়ার ফাঁকে একটু সস চেখে নিয়ে বড়ঞার মুকুন্দ সাহা বলছেন, ‘‘সব বদলে গেল জানেন, হাটের চেহারা থেকে পুরনো চরিত্র— সবটুকুই!’’
হাটতলা জুড়ে নিরিবিলি সেই বড়ঞার হাট এখন রাস্তা দাপিয়ে বলছে, রবি-মঙ্গল-বিষ্যুদ (বৃহস্পতিবার) রাজ্য সড়কে যান চলবে খুঁড়িয়ে। বেগড়বাই করলে?
উত্তরটা দিচ্ছেন এলাকার এক ছোট-ট্রাক চালক, ‘‘হাট বারে গাড়ি নিয়ে ও পথে যাচ্ছিলাম ওইটুকু রাস্তা পার হতে চল্লিশ মিনিট লাগায় বার কয়েক হর্ন মেরেছিলাম। হাটুরেরা এসে পালা করে চড় মেরে গেল!’’
হপ্তার ওই তিন দিন, হাট উজিয়ে চলাচলের প্রশ্নে এমন চড়-থাপ্পড়, বকুনি, গাল-মন্দ খাওয়ার অভিজ্ঞতা কম নয় চালকদের। তাঁরা কেউ, ভ্যান চালক কেউ বা ওই পথে নিয়মিত বাস চালান। রাস্তা জুড়ে জাঁকিয়ে বসা সেই হাটে পাল্টা যুক্তিও শোনা যাচ্ছে— ‘‘তা এত লোকজন একটু আস্তে যাবে না গাড়ি। খান পাঁচেক দুর্ঘটনা তো হয়ে গেল!’’
তবু রাস্তা থেকে নড়বে না থানারপাড়ার হাট। রাস্তা দখল করে ব্যবসা করাই যেন তাদের হক, অধিকার। তবে, দোষটা শুধু থানারপাড়ার ওই হাটুরেদের দিলেই চলবে না। কান্দি মহকুমা জুড়েই এমন রাস্তা-ধখল হাটের সংখ্যা নিছক কম নয়। খড়গ্রাম, ভরতপুর ১ ও ২ আশপাশের পাঁচ ব্লকে এমন হাটের সংখ্যা অন্তত খান দশেক।
বড়ঞার ওই হাটের উপরে বেঁচে রয়েছেন আশপাশের অন্তত খান কুড়ি গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় সব্জি ব্যবসায়ীরা ছাড়াও কান্দি, ডাকবাংলা, কুলি এমনকী বীরভূমের গ্রাম থেকেও সব্জি ব্যবসায়ীরা আসেন। রাস্তা জুড়ে প্রায় প্রায় শ’দুয়েক চাষি পশরা সজিয়ে বিকিকিনি করেন। সপ্তাহের ওই দিনগুলোয় অন্তত হাজার পনেরো লোকের ভিড়, তবু হাটটা রাস্তা থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টা নেই স্থানীয় প্রশাসনের।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নারায়ণ কৈবর্ত্ত্য, টুটুল শেখরা বলছেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি হাটের একটা স্থায়ী জায়গার জন্য। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত শুনলে তো!’’
বড়ঞা ১ পঞ্চায়েত প্রধান কংগ্রেসের সাবিনা ইয়াসমিন হাত তুলে দিচ্ছেন, “জায়গার বড় অভাব। তা ছাড়া পঞ্চায়েতের এমন টাকা নেই যে জায়গা কিনে হাটুরেদের বসার জায়গা করে দেবেন।”
বড়ঞা হাটের চেহারা নিয়েই পড়ে রয়েছে, আন্দি, সুন্দরপুর, গোকর্ণ হাটের। সেখানেও রাস্তা দখল করেই বসছে হাট। শুধু শুক্রবার নয়, কান্দি জুড়ে এমন হাট বসছে নিত্য বারে!
হলদিয়া-ফরাক্কা বাদশাহি সড়ক জুড়ে খড়গ্রামের শেরপুরহাটটাও বড়ঞা হাটেরই প্রতিচ্ছবি। আর সব্জি, আবাদি সামগ্রীর সঙ্গে সেখানে সিডি, দাদ-হাজার ওষুধ, স্টিলের বাসনকোসন— মেলে তা-ও। কান্দির লাগোয়া বীরভূমের গ্রাম থেকে এ হাটেই আসেন, নিত্য দাস। বলেন, ‘‘না এসেও উপায় নেই। কেনাকাটার জন্য সপ্তাহের এই হাটই তো ভরসা। তবে বড় ভয়ও লাগে। বড় রাস্তার উপর হাট কিনা!’’
কান্দির মহকুমাশাসক বিজিন কৃষ্ণ বিষয়টা জানেন। বলছেন, “প্রত্যেক ব্লকে রাজ্য সরকার একটি করে কৃষি বাজার করে দিয়েছে। তারপরেও রাস্তা দখল করে হাট বসলে আর কী বলব?’’
যা শুনে স্থানীয় হাটুরেরা বলছেন, ‘‘কিন্তু কৃষি বাজারের সঙ্গে আটপৌরে হাটের কী মিলমিশ হয়? বরং মাঠের ধারে একটা জমি বেছে দিলে আমরা হাটটা সেখানে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তদ্বির করতে পারি।’’
সে কথা কী শুনতে পাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy