বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড়।
রোগ সারছে না খোদ হাসপাতালেরই।
সীমান্তবর্তী করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিত্সা পরিষেবার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। গত কয়েক বছরে কখনও চিকিত্সায় গাফিলতি, কখনও ওষুধের ঘাটতি, কখনও শয্যা না মেলা ও অকারণে রোগী রেফারের মতো বেশ কিছু বিষয়ে অভিযোগ তুলে হাসপাতালে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন রোগীর পরিজনেরা। একাধিকবার হাসপাতাল সুপারের কাছে এসে অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছেন এলাকার রাজনৈতিক সংগঠনের পাশাপাশি নাগরিক কমিটির সদস্যেরাও। ‘দাওয়াই’ হিসাবে কয়েকজন চিকিত্সককে শো-কজ করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা এসে একাধিকবার বৈঠকও করেন। কিন্তু রোগ নিরাময় তো দূরের কথা দিনকে দিন আরও রুগ্ণ হয়ে পড়ছে এই হাসপাতাল।
সীমান্তবর্তী এই গ্রামীণ হাসপাতালের উপর প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। হাসপাতালের বহির্বিভাগেই প্রতিদিন প্রায় ৬০০ থেকে ৬৫০ জন রোগী আসেন। দৈনিক গড়ে ৪০ জন রোগী ভর্তি হন। রোগীর এই বিপুল চাপ থাকলেও সেই অনুপাতে শয্যা, চিকিত্সক কিংবা অন্যান্য কর্মী রয়েছে অনেক কম। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে হাসপাতালে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। গড়ে প্রতিদিন ১২ জন প্রসূতি ভর্তি হলেও চিকিত্সকের ঘাটতি, সিজারের ব্যবস্থা না থাকার কারণে তিন থেকে চার জন প্রসূতিকে রেফার করে দিতে হয় কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে। এই রেফার যে কতটা প্রয়োজনে আর কতটা দায় ঝেড়ে ফেলার জন্য তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, “বছর কয়েক আগে অভয়পুরের এক তরুণীকে ‘সিজার কেস’ বলে রেফার করা হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। সেখানে গিয়ে ওই তরুণীকে শুনতে হয়েছিল, ‘নর্মাল ডেলিভারির জন্য এখানে কেন? ওটা তো করিমপুরেই হতে পারত’। সেখান থেকে ফের ওই তরুণী করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ফিরে আসেন এবং এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। এরকম ঘটনার সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়।”
সাধারণ মানুষের প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। করিমপুরের প্রসেনজিত্ রায় বলছেন, “আমরাও জানি গ্রামীণ হাসপাতালে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকে না। ফলে তখন ভাল চিকিত্সার জন্য রেফার করতেই হবে। কিন্তু এই হাসপাতালে মাঝে মধ্যে রেফারের বহর দেখলে স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ হয় যে, এই রেফার কতটা যুক্তিসঙ্গত। দূরদুরান্ত থেকে মানুষ খুব অসহায় অবস্থাতেই হাসপাতালে আসেন। এটা চিকিত্সকরা ভুলে গেলে তো খুব মুশকিল।”
হাসপাতাল চত্বরে জমে রয়েছে জল।
করিমপুরের এক ব্যবসায়ী ভূপেন মণ্ডল বলছেন, “চিকিত্সার পাশাপাশি রোগী ও তাঁর পরিজনেরা চিকিত্সকের কাছ থেকে ভাল ব্যবহারও প্রত্যাশা করেন। একটা সময় ছিল যখন চিকিত্সকের কাছে গিয়ে তাঁর মুখ থেকে দু’একটি কথা শুনলেই যেন রোগীর অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ চিকিত্সকই ভাল ব্যবহার তো দূরের কথা, রোগীর সমস্যার কথা ঠিকমতো শোনেন না।”
চিকিত্সকদের পাল্টা যুক্তি, “মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা আর সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার জন্য সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু রোগী বা তাঁদের পরিজনদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য যে পরিকাঠামো থাকা দরকার সেটাই তো নেই এই হাসপাতালে। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরাও সবসময় ভাল পরিষেবা দিতে চাই এবং যতটা সম্ভব সেটা দিচ্ছিও। কিন্তু আমাদেরও তো কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেটাও সকলের বোঝা দরকার।”
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৫৭ সালে করিমপুরে প্রায় ৫.৮৫ একর জমির উপর গড়ে উঠেছিল এই হাসপাতাল। তখন অবশ্য এটা ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পরে এটা গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হলেও নেই এর তালিকাটাই যেন ক্রমে দীর্ঘ হয়েছে। এখন এই হাসপাতালে ১০ জন চিকিত্সকের জায়গায় আছেন মাত্র ৫ জন। ফার্মাসিস্ট থাকার কথা ২ জন। আছেন একজন। এক্স-রে টেকনিশিয়ান, ল্যাব টেকনিশিয়ান হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স চালক, নার্স ও অন্যান্য কর্মী সবই রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ২০০৭ সালে সিজার চালু হওয়ার পরে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় সেই সিজারও বন্ধ হয়ে রয়েছে।
করিমপুর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা স্থানীয় বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “চিকিত্সা পরিষেবা নিয়ে হাসপাতালের সমস্যা বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি হাসপাতাল চত্বরে জল জমা, পানীয় জলের সমস্যা, পর্যাপ্ত আলোর অভাব--এ সব তো আছেই। হাসপাতালের পুরনো ভবন সংস্কার করা দরকার। বাড়ানো দরকার শয্যা সংখ্যাও। রয়েছে নিরাপত্তার সমস্যাও। বিষয়গুলি নিয়ে বহু বার রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর এখনও পর্যন্ত কিছুই করে উঠতে পারেনি।”
হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলছেন, “গত দু’ বছরে বেশ কয়েকজন চিকিত্সক এখান থেকে বদলি হয়ে চলে গিয়েছেন। সেই জায়গায় নতুন কেউ এখনও পর্যন্ত যোগ দেননি। এত কিছু অসুবিধার মধ্যেও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি ভাল পরিষেবা দেওয়ার। হাসপাতালের সমস্যার কথা জেলা স্বাস্থ্য দফতর ও স্বাস্থ্য ভবনেও জানানো হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
এই আশ্বাসের পরে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল কত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে এখন সেটাই দেখার।
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর- নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy