Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ছুটি ফেলে পড়ুয়াদের পাঠ শিক্ষকের

পুজোর ছুটিতে আর সবাই যখন সমুদ্র কিংবা পাহাড় দেখতে ছুটেছেন, তাঁর ঠিকানা তখন স্কুলের ক্লাসঘর। সেখানেই জঙ্গলঘেরা এলাকার শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়াশোনার পাঠ দিচ্ছেন এই শিক্ষক। তিনি ‘তরুণ স্যার’। ঝালদা ১ ব্লকের কলমা পঞ্চায়েতের মেরেন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। ঝালদার মেরেন্দ হাইস্কুলে প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। ঝালদার মেরেন্দ হাইস্কুলে প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

প্রশান্ত পাল
ঝালদা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২১
Share: Save:

পুজোর ছুটিতে আর সবাই যখন সমুদ্র কিংবা পাহাড় দেখতে ছুটেছেন, তাঁর ঠিকানা তখন স্কুলের ক্লাসঘর। সেখানেই জঙ্গলঘেরা এলাকার শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়াশোনার পাঠ দিচ্ছেন এই শিক্ষক।

তিনি ‘তরুণ স্যার’।

ঝালদা ১ ব্লকের কলমা পঞ্চায়েতের মেরেন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঝালদা সদর থেকে এলাকার গ্রামগুলির দূরত্ব কমবেশি ৮-১০ কিলোমিটার। অতদূর পথ পেরিয়ে ঝালদায় গিয়ে গাঁটের কড়ি খসিয়ে ছেলেমেয়েদের টিউশন নিতে পাঠানোর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া গ্রামগুলির পরিবার। এলাকায় তেমন শিক্ষক নেই। আবার সামনেই মাধমিক পরীক্ষা। পরিবারগুলির কাছে তাই মুশকিল আসান— অক্লান্ত তরুণ স্যারের এই বিনাপয়সার পাঠশালা।

স্কুল সূত্রের খবর, তরুণবাবু গত বছরও পুজোর ছুটিতে একই ভাবে স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পড়িয়ে ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর ছুটিতে তাঁর ‘পাঠশালা’য় পড়ার জন্য আবদার করেছিল পরের ব্যাচও। একই অনুরোধ করেন অভিভাবকেরাও। তরুণবাবুর কথায়, “গত বছর পুজোর ছুটিতে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলি দেখিয়ে দিয়েছিলাম। এ বারও পড়ুয়াদের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তাই ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাইনি।” তিনি জানান, মেরেন্দ হাইস্কুলের পড়ুয়ারা প্রত্যন্ত সব গ্রামে থাকে। তিনি কিংবা অধিকাংশ শিক্ষক ঝালদায় থাকেন। কাজেই ওই সব প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে টিউশন পড়তে গেলে তাদের ঝালদা যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এতটা রাস্তা সাইকেলে যাতায়াত করে পড়াশোনা করা ওই সব পড়ুয়ার কাছে কষ্টকর। গ্রামগুলি থেকে সাকুল্যে তিন-চারটি বাস চলাচল করে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও খারাপ। তাই তরুণবাবু ঠিক করলেন পড়ুয়ারা তাঁর কাছে নয়, বরং তিনিই পড়ুয়াদের কাছে যাবেন। তাই পুজোর ছুটিতেও আর পাঁচটা দিনের মতোই রুটিন জারি রয়েছে ওই শিক্ষক ও দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর কথায়, “এই প্রত্যন্ত এলাকায় পড়াশোনার সুযোগ তেমন নেই। তাই সামনের বার যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের দু’একটি বিষয় দেখিয়ে দিলে ভালই তো হয়। তাই ছুটির এই সময়টা যাতে ছাত্রছাত্রীরা ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারে, তরুণবাবু আমার কাছে এ বারও কোচিং দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের বিষয়গুলি দেখিয়ে দিচ্ছেন। এতে ছেলেমেয়েদের উপকারই হবে।”

কী বলছে পড়ুয়ারা?

ছোটগাঁতা গ্রামের প্রদ্যুম্ন মাহাতো, রিগিদ গ্রামের চক্রধর রজক বা কলমা গ্রামের বাবলু মণ্ডলের মতো পড়ুয়াদের চোখে তরুণ স্যারকে ঘিরে মুগ্ধতা যেন কাটছেই না। তাদের ভাষায়, “বেশি পয়সা দিয়ে পড়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। স্যারের কোচিংয়ে আমরা খুবই উপকৃত হচ্ছি।” পালডি গ্রামের ববি মুড়া, বোঙাবাড়ি গ্রামের জবারানি মুর্মু বা ডুমুরডি গ্রামের গীতা মাহাতোরা জানায়, তরুণ স্যার তাদের জানিয়েছিলেন এই ছুটিতে প্রতিদিন অঙ্ক অভ্যাস করে যেতে হবে। তিনি নিজে এসে পড়ানোয় অঙ্কের ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছে।

স্বস্তিতে অভিভাবকরাও। ডুড়গি গ্রামের নীলমোহন মাহাতো, সুবীর রজক, শ্রীহরি মাহাতোদের কথায়, “তরুণবাবু নিজের ছুটি নষ্ট করে এতটা পথ পেরিয়ে শুধু আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে আসছেন, এটা কি কম বড় পাওনা? আরও কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে এলে পড়ুয়ারা আরও বেশি উপকৃত হতো।” রবিবারেও তরুণবাবুর ছুটি নেই। প্রতি রবিবার ঝালদাতেও তিনি পড়ুয়াদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলি নিখরচায় পড়ান।

তাঁর কথায়, “আমি একজন অতি সাধারণ শিক্ষক। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে যতটুকু পারি করার চেষ্টা করছি।” পাশে পেয়েছেন সহধর্মিনী পিয়ালীদেবীকে। তাঁর কথায়, “গোটা বছরই স্কুল আর ছাত্রছাত্রী নিয়েই উনি আছেন। গত বছর পুজোর ছুটিতে নিজের স্কুলে পড়ুয়াদের কোচিং করিয়েছিলেন। তাই কোথাও বেড়াতে যাবেন না জানতামই। তবে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হচ্ছে এটাও কম তৃপ্তির নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prashanta pal tarun sir jhalda teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE