আজ শনিবার, ১ নভেম্বর পুরুলিয়া জেলার জন্মদিন। তার আগে শুক্রবার শিল্পাশ্রমে গাঁধীজির ছবি সাফসুতরো করা চলছে। ছবি: সুজিত মাহাতো।
অনাদরে অবহেলায় পুরুলিয়া শহরের একপ্রান্তে উপেক্ষার চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পাশ্রমে অবশেষে সংস্কারের কাজ শুরু হল। কাজ বলতে অবশ্য আক্ষরিক অর্থে জোড়াতালি দেওয়া সংস্কার।
একদা জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান এবং স্বাধীনতা উত্তর কালে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের এই আঁতুড়ঘর পড়ে রয়েছে শহরের এক কোনে। আশ্রমের এক পাশে নিবারণ স্মৃতি কক্ষ ভেঙে পড়েছে কবেই। উঠোনের বাঁ দিকে মাটির খোলার চালার রান্নাঘরও ভেঙে গিয়েছে সাত বছর আগে। আর আশ্রমের মূল ঘরগুলির কয়েকটির চাল বছর দুয়েক আগে এক ঝড়বৃষ্টিতে উড়ে গিয়েছিল। বছর পাঁচেক ধরে আশ্রম বিদ্যুত্-বিচ্ছিন্ন।
এক সময় এই আশ্রমই ছিল মানভূম কংগ্রেসের সদর দফতর। পরে মতবিরোধের কারণে এই আশ্রমের তত্কালীন নেতৃত্ব কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে লোকসেবক সঙ্ঘ গঠন করেন। তখন থেকেই এই শিল্পাশ্রম লোকসেবক সঙ্ঘের সদর দফতর। সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো বলছিলেন, “আশ্রমের ঘরগুলো নিছক ইট-কাঠ-পাথরের নয়। এর পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।” তিনি জানান, ১৯২১ তে শহরের নীলকুঠিডাঙায় প্রথম এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ঠিকানা বদলে শহরের দেশবন্ধু রোডে উঠে আসে। ১৯২৮ থেকে পাকাপাকি ভাবে শহরের উপকন্ঠে তেলকল পাড়া এলাকায় আশ্রম স্থানান্তরিত হয়।
আশ্রম গড়ে ওঠার পিছনে একটি কাহিনি রয়েছে। ১৯২১ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনে যখন সারা দেশ উত্তাল, তখন তার প্রভাবে জেলা স্কুলের তত্কালীন প্রধান শিক্ষক নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত ও জেলা আদালতের আইনজীবী অতুলচন্দ্র ঘোষ পেশা ছেড়ে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। সে সময় অতুলচন্দ্র ঘোষ-সহ কয়েকজন কংগ্রেস কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এই এলাকার স্বদেশী ভাবধারায় বিশ্বাসী কংগ্রেস কর্মীদের বিদেশি দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি স্বদেশী শিল্প গড়ে তোলার লক্ষেই স্থাপিত হয় শিল্পাশ্রম।.
কে আসেননি এখানে? সুশীলবাবু জানান, ১৯২৫ সালে বিহার কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন উপলক্ষে এখানে আসেন মহাত্মা গাঁধী। অতুলচন্দ্র ঘোষের সহধর্মিনী লাবণ্যপ্রভাদেবী পরবর্তীকালে যিনি আপামর পুরুলিয়াবাসীর কাছে আশ্রমজননী নামে পরিচিত, তিনিই গাঁধীজির দেখভাল করেছিলেন। এই আশ্রমেই এসেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রাজেন্দ্র প্রসাদ। পরে জ্যোতি বসু, অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসে এই আশ্রম বারবার বড় ভূমিকা নিয়েছে।
১৯৪৮-তে গঠিত হয় লোকসেবক সঙ্ঘ। সুশীলবাবুর কথায়, “কংগ্রেসের সঙ্গে মতান্তরের কারণে ১৯৫৬ -র ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিল গৃহীত হলে প্রতিবাদে নামে লোকসেবক সঙ্ঘ। তারপরে মাতৃভাষায় কথা বলা ও লেখাপড়া করার অধিকারের দাবিতে এবং বাংলার সঙ্গে থাকার দাবিতে লোকসেবক সঙ্ঘের ভাষা আন্দোলন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। টুসু গানের সুরে সাংসদ ভজহরি মাহাতোর লেখা গান, ‘শুন বিহারি ভাই তোরা রাইখতে লারবি ডাঙ্গ দেখাঁই’ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষি মানভূমকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এই দাবিতে তখন বঙ্গভুক্তি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। দাবি ওঠে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের যে সিদ্ধান্ত, তা কাযর্কর করতে হবে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার চাই।
বঙ্গ সত্যাগ্রহ অভিযানে যোগ দিয়ে ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে পুঞ্চার পাকবিড়রা থেকে ১০০০-র বেশি মানুষ কলকাতা পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। মানভূমকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করার দাবি তোলা হয়।
পুরুলিয়া থেকে এপ্রিল মাসের রোদ মাথায় নিয়ে পায়ে হেঁটে কলকাতায় পৌঁছে সত্যাগ্রহীরা কারাবরণ করেন। পরে তাঁরা মুক্তি পান। সেই বিলও প্রত্যাহার করা হয়। আর এই এলাকাকে বিহারের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৫-র ১ নভেম্বর পুরুলিয়া গঠিত হয়। এবং বাংলার সঙ্গেই যুক্ত হয়।
মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবময় ইতিহাস এই শিল্পাশ্রমকে ঘিরেই। এক সময় এখানে চরকা কাটা হতো। সেই সুতোয় কাপড়ই পরা হতো। আজ ভাঙা ঘরের আবর্জনার সঙ্গে পড়ে রয়েছে চরকাও। নিবারণ কক্ষের ঘরের ছাদ পড়ে গিয়েছে। পুরুলিয়ার প্রথম মহিলা বিধায়ক মানভূম জননী লাবণ্যপ্রভাদেবী যে ঘরে থাকতেন পড়ে গিয়েছে সেই ঘরের দেওয়ালও। সুশীলবাবু বলছিলেন, “পুরনো দিনের প্রচুর নথি, সাদা-কালো ছবি-সহ নানা দুর্লভ নিদর্শন বেশ কিছুদিন ধরেই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম কেউই এগিয়ে আসছেন না। আর সংস্কারের কাজে অনেক খরচ! তাই সাধারণ মানুষের কাছ চেয়ে চিন্তে কোনওরকমে সংস্কারের কাজ শুরু করলাম। দেখি কতটা পারা যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy