প্রতীকী ছবি।
হাড়কাঁপানো ঠান্ডা একটু কমেছে। তবুও কুয়াশা জড়ানো শীতের সকালে মকরস্নান করতে হলে বুক কেঁপে যেতে বাধ্য। কিন্তু অন্য ছবি দেখা গেল তন্ত্রেশ্বরে।
রাজনগর ঘেঁষে থাকা ঝাড়খণ্ডের তন্ত্রেশ্বরে গরম জলে মকরস্নান সেরে শতাব্দীপ্রাচীন বাবা তন্ত্রেশ্বর (শিব) মন্দিরের পুজো দিয়ে দিনভর মকর মেলায় ঘোরার সুযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য তন্ত্রেশ্বর না বলে বলেন তাঁতল। বক্রেশ্বরের সঙ্গে তাঁতলয়ের মিল হল, এখানেও বক্রেশ্বরের মতো উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। তফাৎটা হল, বক্রেশ্বরে উষ্ণপ্রস্রবণ থাকলেও মকর মেলা বসে না।কিন্তু মকর সংক্রান্তির দিন তন্ত্রেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে বসে এক দিনের মেলা। ঢল নামে মানুষের।
তন্ত্রেশ্বরের অবস্থান ঝাড়খণ্ডের রনিশ্বর ব্লকের টোংরা থানা এলাকায়। শতাব্দীপ্রাচীন তন্ত্রেশ্বরে এই মেলা এক দিনের হলেও তাকে উপভোগ করতে ঝাড়খণ্ড, রাজনগরের অনেক গ্রামের মানুষ ভিড় করেন। আদিবাসীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। রবিবার মকরসংক্রান্তির দিন তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মকর সংক্রান্তিতে মেলা বসে মূলত নদীর পাশাপাশি। সকালে মকরস্নান, তার পরে স্থানীয় মন্দিরে পুজো দিয়ে মেলায় ঘোরা। তন্ত্রেশ্বর শিবমন্দিরও রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী নদীর পাশে। কিন্তু উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য মেলায় আসা পূণ্যার্থীরা নদীর ঠান্ডা জলে স্নান না করে আরামে মকরস্নান সারতে পারেন গরম জলে।
রবিবার সকাল ৮টা নাগাদ মেলায় পৌঁছে দেখা গেল, কুয়াশা ফুঁড়ে জেগে উঠতে শুরু করেছে গ্রামীণ মেলা। পসরা সাজিয়ে প্রস্তুত দোকানিরা। সদ্য সাদা রঙের প্রলেপ পড়া প্রাচীন শিব মন্দিরের সামনে ডালি সাজিয়ে বিক্রেতারা অপেক্ষায় রয়েছেন পূণ্যার্থীদের। আসতে শুরু করেছে মানুষ। মন্দিরের পুরোহিত বাবুসিংহ মুর্মূ, অনাথ পাণ্ডাজিরা বলেন, ‘‘এই দিনটা অন্য পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা। এত বছর ধরে পুজো করছি, প্রতি বার একই রকম উদ্দীপনা। কত মানুষ মেলায় আসেন।’’
দুই পুরোহিতের কথা সত্যি করে বেলা যত গড়িয়েছে ভিড় বেড়েছে।
এক দিকে সিদ্ধেশ্বরী নদী পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের বোড়া, বাঁশবোনা মুরগুনি, টোংরা, বৃন্দাবনী, সোনাচুড়া-সহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ, অন্য দিকে রাজনগরের রুহিদা, পটলপুর, হিরাপুর, সিসালফার্মে মতো গ্রাম থেকে কেউ সাইকেল, কেউ মোটরবাইক বা কেউ ছোট চার চাকায় পৌঁছেছেন মেলায়। অনেকে এসেছেন গরুর গাড়িতে। ফসল উঠে যাওয়ার পর নদীর পাশে উঁচু নীচু জমি বা ধানখেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে প্রচুর স্টল। স্টলগুলিতে যেমন গৃহস্থালির জিনিসপত্র রয়েছে, তেমনই রয়েছে খাবার দোকান। স্থানীয় ‘এক্ষাণ’ (লক্ষ্মীপুজো) পুজোর জন্য বিক্রি হচ্ছে পোড়া মাটির ঘোড়া। স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন অনেকেই। সন্ধ্যায় গানের আসর বসার জন্য তৈরি মণ্ডপ। মেলার ঘোরার পাশাপাশি কেউ কেউ নদীর চরে জনিয়ে পিকনিক করছেন। স্বামী প্রাণবল্লভবের সঙ্গে মেলায় এসেছিলেন বাঁশবোনা গ্রামের দিদিমণি হাঁসদা। গৃহস্থালির জিনিস কেনাকাটা করতে করতে বললেন, ‘‘সারা বছর মুখিয়ে থাকি । একটা দিন দারুণ কাটে।’’ রাজনগরের গংমুড়ি থেকে মেলায় স্ত্রী জুলিকে নিয়ে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান সেরে পুজো দিতে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, ‘‘অনেক বছর ধরে মেলায় আসছি। শহুরে মেলার মেলার কোনও ছাপ নেই এখানে।’’
মেলা দেখতে এসেছিলেন রুহিয়া গ্রামের প্রৌঢ় নিহার চৌধুরী। তিনি বলছেন, “যত দিন ধরে মেলা দেখছি তাতে তফাৎ একটাই। যে স্টলগুলি বসেছে সেগুলি ঝকঝকে। বহু বছর আগে মাটিতে মাদুর, ত্রিপল, প্লাস্টিক পেতে স্টল বসত। এখন সেগুলি দোকানের মতো তৈরি করা হয়। বাকি সব একই।” তন্ত্রেশ্বরের রামজীবন টুডু, মীরা টুডু বলেন, “বাড়ির কাছে মেলা। সকালে এসে সন্ধ্যায় ফিরি।” বোলপুর থেকে রামজীবনের শ্যালিকা সুস্মিতা এসেছেন গ্রামীণ মেলায়। মেলার স্টুডিয়েতে ছবি তোলাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘একেবারে ভিন্ন স্বাদ এই মেলার।’’ বোড়া গ্রামের জলধর রোওয়ানি মিষ্টির দোকান দিয়েছেন, কারিগর রাজনগরে সাহাবাদের জগন্নাথ মাজি। লোহার সামগ্রী নিয়ে মসলিয়া থেকে এসেছেন জুর্গু রানা। তাঁরা সবাই বলেন, “যা নিয়ে এসেছি সব বিক্রি হয়ে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে না।” মেলায় যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ২০-২৫ জন পুলিশকর্মী মেলার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। তবে এলাকাবাসীর আক্ষেপ একটাই— উষ্ণ প্রস্রবণ থাকা সত্বেও পর্যটন কেন্দ্র গড়ায় যে ভাবে নজর নেই প্রশাসন, সরকারের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy