Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ফের বালির গাড়ি পিষল ছাত্রকে

শুক্রবার সকালে বালি বোঝাই ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে সাঁইতাড়া-পরাশিয়া রাস্তায় মৃত্যু হয়েছে জাকির আলি খানের (১৬)। বাঁকুড়ার জয়পুরের সাধুয়াঢাল গ্রামের বাসিন্দা জাফরের বড় ছেলে জাকির। দশম শ্রেণিতে পড়ত।

জাকির আলি খান। ছবি: শুভ্র মিত্র

জাকির আলি খান। ছবি: শুভ্র মিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
জয়পুর শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০১:৫৩
Share: Save:

পাকা রাস্তা ছিল কোনও এক কালে। মোরামের তাপ্পির নীচে তার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। এখন ধুলো উড়িয়ে অহরহ ছুটে চলে বালির গাড়ি। জাফর আলির কাজ ছিল, ধুলো কমাতে রাস্তায় জল ঢালা। কিছুদিন আগে পঞ্চায়েত ঠিক করল, নিজেরাই জল ঢালবে। জাফরের কাজ গিয়েছিল। এ বার ছেলেকেও কেড়ে নিল রাস্তা।

শুক্রবার সকালে বালি বোঝাই ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে সাঁইতাড়া-পরাশিয়া রাস্তায় মৃত্যু হয়েছে জাকির আলি খানের (১৬)। বাঁকুড়ার জয়পুরের সাধুয়াঢাল গ্রামের বাসিন্দা জাফরের বড় ছেলে জাকির। দশম শ্রেণিতে পড়ত। এ দিন সকালে মুদির দোকানে বাড়ির জন্য জিনিসপত্র কিনে আনতে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার ভানু বাগ বলেন, ‘‘দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই হোঁচট খেয়ে পড়ল ছেলেটা। বালি বোঝাই ট্রাক্টর আসছিল। চাকায় পুরো পিষে গেল।’’ স্থানীয় মানুষজন মোটরবাইকে চড়িয়ে দ্রুত জাকিরকে গোগড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক জানান, আনার আগেই মৃত্যু হয়েছে ওই কিশোরের।

২০১৭-র জানুয়ারিতে এই রাস্তাতেই বালির গাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যু হয় নবম শ্রেণির এক স্কুল পড়ুয়ার। ক্ষুব্ধ জনতা তার পরে বালি বোঝাই ৯টি ট্রাকে আগুন দিয়ে দিয়েছিল। এ দিনের দুর্ঘটনার পরেও এলাকায় প্রবল ক্ষোভ দেখা দেয়। এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) সুকোমলকান্তি দাস বাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢুকতে গিয়ে বাধা পান। গ্রামবাসীর সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। তিনি জানান, ট্রাক্টরটির চালক পুরন্দরপুর গ্রামের কাদের মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ট্রাক্টর। মৃতদেহ ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

তার মা সাবিনা বিবি। ছবি: শুভ্র মিত্র

কিন্তু বেপরোয়া বালির গাড়ির উৎপাত আর কবে কমবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এসডিপিও জানিয়েছেন, ওই রাস্তা দিয়ে বালির গাড়ি চলাচল এখন বন্ধ রাখা হয়েছে। আজ, শনিবার গ্রামবাসীর সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিষ্ণুপুর-আরামবাগ (২ নম্বর) রাজ্য সড়কের সাঁইতাড়া থেকে রাস্তাটি বেরিয়ে চলে গিয়েছে পরাশিয়া পর্যন্ত। পরাশিয়া গ্রাম লাগোয়া দ্বারকেশ্বরে বেশ কিছু বালি খাদান রয়েছে। এ দিনের দুর্ঘটনা এবং বিক্ষোভের পরে জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নবকুমার রুইদাস বলেন, ‘‘ছাত্রের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু বালি খাদান থেকে তো সরকার প্রচুর টাকা রাজস্ব পায়। সরকারি রাস্তা ব্যবহার না করতে দিলে চলবে কী করে?’’ তাঁর দাবি, বাইপাস করার জায়গা নেই। তবে জানিয়েছেন, রাস্তা সারইয়ের জন্য ৬০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে জেলা পরিষদ। তা দিয়ে ৬ কিলোমিটার রাস্তার ২ কিলোমিটার সংস্কার করা হবে।

ঘটনাটি যে দুঃখজনক এবং রাস্তাটি যে দীর্ঘ দিন ধরে বেহাল হয়ে রয়েছে— তা মেনে নিয়েছেন এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা। তিনি বলেন, ‘‘বাম আমল থেকে ওই রাস্তা বেহাল।’’ পরিবারটির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন শ্যামলবাবু।

দুর্ঘটনার পরে রাস্তায়। ছবি: শুভ্র মিত্র

এ দিন দুর্ঘটনার পরে বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন কারকবেড়িয়া পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের শিখা বাগ। তিনি বলেন, ‘‘অনেক বার গ্রামের লোকজন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েছে। আমিও বলেছি। দলের নেতারা গুরুত্ব দেননি।’’ তবে জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ রবিয়াল মিদ্যার বক্তব্য, প্রত্যেক বছর নিয়মিত পঞ্চায়েত রাস্তা সারাই করে।

রাস্তায় যখন বিক্ষোভ চলছে, বাড়ির মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন জাকিরের মা সাবিনা বিবি আর বাবা জাফর আলি খান। তাঁদের সামলানোর চেষ্টা করছিলেন পড়শিরা।

স্থানীয় বৃদ্ধা জনু বিবি, হাসিনা বিবিরা বলেন, ‘‘ওই রাস্তার বাঁকেই জল ছড়াতো জাফর। কাজটাও গেল। ছেলেটাও অকালে চলে গেল।’’ তাঁরা জানান, একটি ইঞ্জিন ভ্যান চালিয়ে জাফর অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের পড়াচ্ছিলেন।

পঞ্চায়েত সমিতির দাবি, গত বছর দুর্ঘটনার পরে বালির গাড়ি খাদানে যাওয়া আর বোঝাই হয়ে ফেরার রাস্তা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কিছু বাসিন্দা জানান, ওই রাস্তা দিয়ে এখন রোজ কয়েকশো বালির ট্রাক আর প্রচুর বালির ট্রাক্টর যাতায়াত করে। তাঁরা বলেন, ‘‘রাস্তা সংস্কার মানে তো কয়েক ঝুড়ি মোরাম এনে ফেলা।’’ অভিযোগ, ধুলোর চোটে দিনেও জানালা দরজা বন্ধ করে আলো জ্বেলে বসে থাকতে হয়। বর্ষায় এক হাঁটু লাল কাদা। স্থানীয় বাসিন্দা কিসমত খান, সুকুর আলিরা বলছেন, ‘‘আমরাও সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। এই রাস্তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাব কোন ভরসায়?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Accident Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE