Advertisement
০৮ মে ২০২৪

বৃদ্ধ হিতেনই পুতুল নাচের শেষ চরিত্র

তিনি বেহুলা, তিনি-ই লক্ষ্মীন্দর। তার এক হাতে সতী তো অন্য হাতে সত্যবান। আবার কখনও তার গলায় রাজা হরিশচন্দ্র। সুতো বেঁধে রাকা হাতের আঙুল যত নড়েচড়ে ততই নেচে ওঠে পুতুলগুলো। সে পুতুল-ই বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর। যা দেখে দর্শকদের হাততালি পড়ে।

হিতেন বর্মন।—নিজস্ব চিত্র।

হিতেন বর্মন।—নিজস্ব চিত্র।

নমিতেশ ঘোষ
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০২:০৬
Share: Save:

তিনি বেহুলা, তিনি-ই লক্ষ্মীন্দর। তার এক হাতে সতী তো অন্য হাতে সত্যবান। আবার কখনও তার গলায় রাজা হরিশচন্দ্র। সুতো বেঁধে রাকা হাতের আঙুল যত নড়েচড়ে ততই নেচে ওঠে পুতুলগুলো। সে পুতুল-ই বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর। যা দেখে দর্শকদের হাততালি পড়ে। চোখে মুখে তৃপ্তি ফুটে ওঠে হিতেন বর্মনের। শুরু হয়েছিল ১১ বছর বয়সে। এখন ৬৩। কিন্তু হিতেনবাবুর আঙ্গুল থেমে নেই।

কোচবিহারের পুতুল নাচের গল্পে হিতেনবাবুই যেন শেষ চরিত্র। কোচবিহারে এখন পুতুল নাচের ‘পালা’ বলতে এক নামে সকলে হিতেনবাবুকেই চেনেন। তাঁর কথায়, “এক সময় সারা বাংলায় ৩৩টি পুতুল নাচের দল ছিল। এখন একমাত্র আমার দল ছাড়া কেউ নেই বললেই চলে। যারা দু-একজন রয়েছেন তাঁরা ‘পালা’ করেন না। বিজ্ঞাপন জাতীয় কাজ করেন। যা অবস্থা তাতে আমার পরে আর কেউ পুতুল নাচের দল নিয়ে থাকবে বলে মনে হয় না। আমার ছেলেরাও অন্য কাজে আগ্রহী।”

বাসিন্দারা জানালেন, পুতুল নাচে দেখানো সব কাহিনি হিতেনবাবুর মুখস্থ। এক সময়ে হিতেনবাবুর বাবা রাজেনবাবু পুতুল নিয়ে ঘুরে বেরাতেন। যেখানে ভিড় জমত, সেখানেই পুতুল নাচ দেখাতেন। তা দিয়েই সংসার চলত। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রাথমিকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে হিতেনবাবু বাবার সঙ্গে হাটে-বাজারে ঘুরতে শুরু করেন বলে জানিয়েছেন।

নিজেই কাঠ কেটে পুতুল তৈরি করেন তিনি। সেই পুতুল এক-একটি চরিত্র। পুতুল নাচের দল গড়ে তোলেন হিতেনবাবু। গ্রামের যেখানেই মেলার আসর বসে সেখানেই ক্যাম্প খাঁটিয়ে পুতুল নিয়ে হাজির হন হিতেনবাবুরা। যখন শুরু করেছিলেন তখন টিকিটের দাম রাখা হয়েছিল ১৯ পয়সা। তার পর বেড়ে হয় ৫০ পয়সা। এখন ১০ টাকা। হিতেনবাবু জানান, প্রথম দিকে খালি গলাতেই চিত্‌কার করে ‘পালা’ গাইতেন। যখন গলা দিয়ে যে রকম সুরের প্রয়োজন হত তাই বের করতে হতো। তার তালে নাচত আঙুলে সুতো বাঁধা পুতুলও। বছর ১৫ আগেও গ্রামে-গঞ্জে মেলায় পুতুল নাচ দেখতে ভিড় উপচে পড়ত বলে তিনি জানিয়েছেন। সেই ভিড়ে বিশেষ করে ছোটদের উত্‌সাহ থাকত তুঙ্গে।

জানা গেল, এক একটি পুতুল নাচের দলে ৮ থেকে ১০ জনের প্রয়োজন হয়। কেউ বাজনা বাজায়, কেউ পুতুল নাচায়। কেউ গান গাইবেন, কেউ বা টিকিট তাউন্টার সামলাবেন। গান, কথা বলা এবং পুতুল নাচানোর কাজ হিতেনবাবু নিজেই করতেন। এখন অবশ্য নিজের ভাইপো স্বপন বর্মনকে পুতুল নাচের কাজ শিখিয়েছেন। তিনি বেশিরভাগ সময় শুধু সংলাপ বলেন আর গান গেয়ে থাকেন। অন্তত পক্ষে ২০ টি কাহিনি তারা মঞ্চস্থ করেন। সতী, বেহুলা, রাজা হরিশ্চন্দ্র, ময়নার চোখের জল থেকে শুরু করে ২০ টি কাহিনি তাঁর মুখস্থ বলে জানালেন। হিতেনবাবুর সংসারে টানাটানিও রয়েছে। সে জন্য দুর্গা ও কালী পুজোর সময় বরাত নিয়ে কঙ্কালের পতুল, পশু, পাখি তৈরির কাজও করেন।

যত দিন গড়িয়েছে, পুতুল নাচে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। এখন মেলা বসে, কিন্তু ভিড় তেমন থাকে না বলেই অক্ষেপ হিতেনবাবুর। একের পর এক পুতুল নাচের দল উঠে গিয়েছে। তবে হিতেনবাবু হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি বলেন, “আমি ও পুতুল এক হয়ে গিয়েছি। পুতুল ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও পারি না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE