Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

মানবিকতার সাহস

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে সারা জীবনের কৃতিত্বের পুরস্কার গ্রহণ করিতে গিয়া হলিউড অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ একটি জরুরি কাজ করিয়া ফেলিলেন। না, আর কয়েক দিন পর যে নূতন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যভার গ্রহণ করিবেন, তাঁহার তীব্র সমালোচনাই সেই জরুরি কাজ নয়।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৩
Share: Save:

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে সারা জীবনের কৃতিত্বের পুরস্কার গ্রহণ করিতে গিয়া হলিউড অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ একটি জরুরি কাজ করিয়া ফেলিলেন। না, আর কয়েক দিন পর যে নূতন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যভার গ্রহণ করিবেন, তাঁহার তীব্র সমালোচনাই সেই জরুরি কাজ নয়। জরুরি কাজটি হইল, নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হইতে আমেরিকার মানসজগতে যে তীব্র বিভাজন ঘটিয়া গিয়াছে, অথচ কোনও এক অদৃশ্য কারণে সেই দুই শিবিরের মধ্যে কথোপকথন, আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের স্বাভাবিক পরিসরটি স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে— মেরিল স্ট্রিপের বক্তৃতা আকস্মিক ভাবে সেই পরিসর উন্মুক্ত করিয়া দিতে পারিল। ত্বরিতে দুই পক্ষ হইতে তীব্র তিক্ত আঘাত ও তিক্ততর প্রত্যাঘাত আরম্ভ হইল। রুচিশীল রাজনীতি ইহাতে ক্ষুণ্ণ বোধ করিতে পারে। কিন্তু রাজনীতি তো কেবল রুচির বিষয় নয়, সামাজিক বাস্তবের প্রতিফলকও বটে। সামাজিক বিভেদ বাস্তব হইলে রাজনীতিতেও আঘাত-প্রত্যাঘাত প্রতিফলিত হইবার কথা। স্তব্ধতা বা অবরুদ্ধতা কোনও সুস্থ পরিণতি হইতে পারে না। সমাজের আভ্যন্তর অ-রুচি, অভিরুচি বা বিকার, সকলই বাহির হইয়া আসা সুলক্ষণ। মেরিল স্ট্রিপ এই কারণেই বিশেষ ধন্যবাদ পাইবেন। তাঁহার সংবেদনশীল বক্তব্যটি তেমন কিছু বিপ্লবী নহে, নিতান্ত মানবিক। তবু তাহা শুনিয়া কিছু মানুষ যেমন ভাবিলেন, ইহাপেক্ষা স্বাভাবিক কিছু হইতে পারে না। আর কিছু মানুষ অমনই তীক্ষ্ণ নখদন্ত বাহির করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, ট্রাম্প-দুনিয়ায় তাহাও অস্বাভাবিক বলা চলে না।

মার্কিন সমাজ যে এই মুহূর্তে কোন্ অতল বিভাজিকার সামনে দাঁড়াইয়া, ইহাই তাহার মোক্ষম প্রমাণ। আবার, এই ভয়াল বিভাজিকার সামনে এক জন চলচ্চিত্রশিল্পী যে জনপ্রিয়তা বা রাষ্ট্রপ্রিয়তার সকল হাতছানি তুচ্ছ করিয়া কুরুচি, হিংসা, মানসিক বিকারের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করিতে পারেন, সেখানেই ওই সমাজের সুস্থতার আশাও নিহিত রহিয়াছে। মেরিল স্ট্রিপের কথাগুলি সহজ মানবিক উচ্চারণ শুনাইতে পারে, কিন্তু তাঁহার কাজটি সহজ ছিল না। তিনি নিশ্চয়ই জানিতেন যে অনেকে যেমন তাঁহাকে সাধুবাদ দিবে, অনেকেই তাঁহার মুণ্ডপাত করিবে। তবুও, প্রবল ক্ষমতাময় ‘এস্টাবলিশমেন্ট’-এর চূড়ায় দাঁড়াইয়াও তিনি ব্যক্তিগত ঝুঁকি লইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিলেন না। অভিনয়জীবনের সায়াহ্নে আসিয়া এই ঝুঁকি লইতে তিনি সম্ভাব্য বিপদের পরোয়া করিলেন না। তাঁহার মানবিক উপলব্ধি অবিতর্কিত স্বীকৃতির সহজ লোভকে ছাড়াইয়া গেল।

যে দেশের প্রধান শিল্পী-সমাজ কেবল মানবিকতার খাতিরে ঝুঁকি লইতে সাহস করে, সে দেশের শক্তি সামান্য নয়। শিল্পীরা নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয়। তাঁহাদের জনপ্রিয়তা বহু ক্ষেত্রে তাঁহাদের বক্তব্যের বাহন হইয়া ওঠে। হলিউড যে সেই শক্তি রাখে, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে যুঝিয়া সেই শক্তির পরীক্ষা দেওয়ার সাহস রাখে, ভিয়েতনাম যুদ্ধ হইতে আজ পর্যন্ত তাহা বারংবার প্রমাণিত। সমাজের মধ্যে যদি অসহনশীলতার পোকা কিলবিল করিয়া ছড়ায়, যাহা কিছু আলাদা ও অন্য তাহার প্রতি অস্বীকৃতি হিংসা হইয়া ঝরিয়া পড়ে, এবং রাষ্ট্র তাহার তোষণ ও পোষণে কোমর বাঁধিয়া নামে, তখন নাগরিক সমাজের উপর ভরসা রাখা ছাড়া উপায় কী। দুর্ভাগা সেই দেশ, যাহার নাগরিক সমাজে সেই ভরসা ও প্রতিশ্রুতি থাকিলেও তাহার শিল্পী-সমাজ সুযোগ পাইলেই ক্ষমতা ও অর্থের প্রলোভনে কিংবা পীড়নের ভয়ে সটান আত্মবিক্রয় করিয়া দেয়, অন্য শিল্পীর ধর্ম-দেশ পরিচয় ভিন্ন বলিয়া তাঁহাকে বা তাঁহাদের বহিষ্কারে অথবা নিষেধাজ্ঞায় সম্মতি দেয়। মেরিল স্ট্রিপের সাহস দেখিয়া বলিউডের আত্মবিক্রয়কারীদের এতটুকুও অন্তর্দাহ ঘটিল কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE