রাজ্যে আইনহীনতার শিখা লেলিহান হইলে হাসপাতালও যে তাহার গ্রাসের বাহিরে থাকিতে পারে না, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ তাহা প্রমাণ করিয়াছে। কোরপান শা নামক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের হত্যাকাণ্ডে ছাত্রদের যোগ কতখানি, তাহা জানিতে এখনও পুলিশি তদন্তের অপেক্ষায় থাকিতে হইবে। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলিতেছে, হস্টেল চত্বরে এত সাংঘাতিক একটি ঘটনা আবাসিকদের অজ্ঞাতসারে হওয়া দুষ্কর। ঘটনার পরের দিন যে রাজমিস্ত্রি গণমাধ্যমে কথা বলিয়াছিলেন, তাঁহার আর দর্শন না মেলাও তাৎপর্যপূর্ণ। সত্যই যদি ছাত্ররা এমন ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তবে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, তাঁহাদের কি নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভয় নাই? ডাক্তারি পাশ করিবার পর যে জীবন তাঁহাদের অপেক্ষায় আছে, এমন হত্যাকাণ্ডে জড়াইয়া সেই জীবনকে তাঁহারা হাতছাড়া করিতে চাহিবেন কেন? গণপ্রহারের ঘটনা পূর্বপরিকল্পনানুসারে ঘটে না, সত্য, কিন্তু শাস্তির ভীতির লেশমাত্র যে তাঁহাদের মধ্যে ছিল না, তাহাও সমান সত্য। এই ভীতিহীনতার একটিই কারণ। রাজ্যের ঘটনাক্রম তাঁহাদের শিখাইয়াছে, ঠিক রাজনৈতিক খুঁটি থাকিলে কোনও অপরাধেই কোনও শাস্তির সম্ভাবনা নাই। তাঁহারা এই সর্বব্যাপী নৈরাজ্যের সন্তান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-রোপিত বিষবৃক্ষের ফল।
আইনের শাসন মুছিয়া ফেলিবার ইহাই বৃহত্তম বিপদ। ডাক্তারির ছাত্রদের সহিত কৃতবিদ্য সমাজবিরোধীদের ফারাক আছে। প্রথম শ্রেণিভুক্তরা স্বভাবত অপরাধপ্রবণ নহে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাহারা আইনকে ভয় পায়, ফলে বড়সড় অপরাধ এড়াইয়াই চলে। কিন্তু, সার্বিক নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা হইলে আইনের ভয় বিষয়টিই বায়বীয় হইয়া যায়। আইনের শাসন তখন ফাইলের আড়ালে, টেবিলের তলায় আশ্রয় খুঁজিতে ব্যস্ত হইয়া পড়ে, ঠিক আলিপুর থানার পুলিশের ন্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাহার ইচ্ছাময়ী নেত্রীর কৃতিত্ব, পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য সর্বময় হইয়াছে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ উদাহরণমাত্র। শাস্তি না হইবার নিশ্চয়তা সর্বত্রই ঘুণ ধরাইতেছে। গত রবিবার হইতে গোটা সপ্তাহ জুড়িয়া এনআরএস-এ যে কুনাট্য চলিতেছে, তাহা এই বাস্তবেরই আরও এক বহিঃপ্রকাশ। আবাসিক ছাত্রদের নামের তালিকা এই এক সপ্তাহে পুলিশের হাতে পৌঁছাইল না, কোনও তদন্ত হইল না। হইবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কোরপান শেখের স্ত্রীর সর্বাঙ্গে ফুটিয়া থাকা অবিশ্বাস যে কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন প্রশাসনের গালে করাঘাতের ন্যায় আছড়াইয়া পড়িত। কিন্তু, এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যে প্রশাসনের মেরুদণ্ড নাই, আত্মসম্মান বোধ অনেক দূরের কথা।
আঁচ মিলিতেছে, এই ঘটনাটির গায়েও কয়েক পরত রাজনৈতিক রঙ লাগিয়া আছে। হাসপাতালের ছাত্র ইউনিয়ন তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে, অতএব ছাত্ররা অপরাধী হইলেও তাহাদের আড়াল করাকেই কালীঘাট সম্ভবত কর্তব্য জ্ঞান করিতেছে। তাঁহারা পশ্চিমবঙ্গকে কোন অতলে লইয়া যাইতেছেন, তৃণমূল নেতৃত্বের সেই বোধ নাই। তাঁহারা দলীয় স্বার্থরক্ষাকেই ধ্রুব জ্ঞান করিয়াছেন। দলের পতাকাতলে আশ্রয় লইলেই সাত খুন মাফ— দলতন্ত্রের এমন কদর্য রূপ বাম আমলেও দেখা যায় নাই। তখন অন্তত আইনের শাসনের ধোঁকার টাটিখানি বজায় ছিল। এখন সেই বালাইও ঘুচিয়াছে। সামাজিক বোধ, আইনের প্রতি ভীতি, সহাবস্থানের মানসিকতা— সভ্য সমাজে থাকিবার প্রাথমিক শর্তগুলি শিথিল হইয়া ক্রমে মানুষের আদিম, হিংস্র রূপ প্রকাশ পাইতেছে। নৈরাজ্যে যেমন হয়। যত দ্রুত এই অতল স্পর্শ করিতে পারিবার কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অর্জন করিল, গোটা দুনিয়ায় তাহার তুলনা মিলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy