Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অনেক ভক্ত একটু রক্ত

আরে, পি সি সরকার যখন এক টুসকিতে অদৃশ্য হয়ে যেত, তার পরে হুড়ুম করে এফ রো-র দর্শকের সিটের তলা থেকে বেরিয়ে ‘হিয়ার অ্যাম আই!’, তখন তো কেউ দোষ ধরেনি! আমি একটা সামান্য ‘ম্যাজিক চেয়ার’ বসালেই স্ক্যান্ডাল! আহা, এটা নিছক মজা, দেহাতি ভক্তগুলোর কাছে জম্পেশ ইম্প্রেশন জমানোর রস-ছেটানো তরিকা! ঝাঁ-চকচক এয়ারকন্ডিশন্ড উপদেশ-কক্ষ, যার সামনে একটা বুলেটপ্রুফ কাচ, তার মধ্যে দিয়ে দর্শকরা দেখবে আমি সিংহাসনে চড়ে চোঁওও আবির্ভূত হলাম!

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

আরে, পি সি সরকার যখন এক টুসকিতে অদৃশ্য হয়ে যেত, তার পরে হুড়ুম করে এফ রো-র দর্শকের সিটের তলা থেকে বেরিয়ে ‘হিয়ার অ্যাম আই!’, তখন তো কেউ দোষ ধরেনি! আমি একটা সামান্য ‘ম্যাজিক চেয়ার’ বসালেই স্ক্যান্ডাল! আহা, এটা নিছক মজা, দেহাতি ভক্তগুলোর কাছে জম্পেশ ইম্প্রেশন জমানোর রস-ছেটানো তরিকা! ঝাঁ-চকচক এয়ারকন্ডিশন্ড উপদেশ-কক্ষ, যার সামনে একটা বুলেটপ্রুফ কাচ, তার মধ্যে দিয়ে দর্শকরা দেখবে আমি সিংহাসনে চড়ে চোঁওও আবির্ভূত হলাম! এত ক্ষণ হয়তো স্বর্গে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম! আসলে একটা হাইড্রলিক লিফ্ট লাগানো, চেয়ারটা তলা থেকে আস্তে উঠে আসে। মার্কেটিং-এর যুগ বাবা। সব নায়িকা ফোটোশপ-করা, সব নায়ক টাকে চুুল-পোঁতা, সব ফেসবুক-ছবি অবধি অল্প টাচাটাচির পর ফাইনাল। আর আমি, একটা ধর্মগুরু, যার ঘাড়ে কন্টিনিউ ফুটছে ধমের্র মহান পতাকার স্ট্যান্ড, এই সার্কাসগুলো অপনাব না? ওরে, ভারতবর্ষ ধর্মের দেশ, আর ধর্ম হচ্ছে অলৌকিকের মাসতুতো। এই ফিল্ডে, শুকনোশাকনা নাক নেড়ে ‘ত্যাগ করো’ না-কপচে, ফট করে আকাশ থেকে হাত ঘুরু ঘুরু ল্যাবেঞ্চুস এনে, তবে লেস্ন পুকারিতে হয়। এয়ারকন্ডিশনও নিজের আরামের জন্যে করেছি না কি? ধুস। কপালে টোব্লা টোব্লা ঘাম দেখতে পেলে, গুরুকে নেহাত ভাই-ভাতিজা ভ্রম হবে। মনে হবে, ব্যাটা ঢেকুর তোলে, হয়তো বাহ্যেও যায়। এ কিনা ভগবানের এজেন্ট? এট্টু দেখনবাজি না ফলালে, আনপড় ভক্তকে সত্‌মার্গে ফোকাসিত রাখা যায় না, পুলিশ এলে ঢাল হিসেবে সামনে দাঁড় করিয়েও দেওয়া যায় না।

আমি অবশ্য কাউকেই দাঁড় করাইনি। মাইরি। অত প্ল্যান করা আমার চরিত্রেই নেই। যখন হরিয়ানা সরকারের জলসেচ দফতরে একটা সামান্য এঞ্জিনিয়ারের কাজ করতাম, অমনোযোগের কারণেই চাকরি গেল। সেই আমি ধুমাধাড় ব্লুপ্রিন্ট বাগিয়ে এতগুলো মহিলা আর শিশুকে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দেব? আশ্রম ভর্তি মজুত রাখব পেট্রোল বোম? পেট্রোল ভর্তি পিচকিরি? ঠাঁইঠাঁই বন্দুক? ন্যাকড়া জড়ানো কাঠ, যাতে সেগুলো জ্বালিয়ে পুলিশের দিকে ছোড়া যায়? আহা, প্রাইভেট কম্যান্ডো পুষেছি ঠিকই গুচ্ছ গুচ্ছ, কিন্তু সে তো পুলিশের সঙ্গে হুড়ুদ্দুম যুদ্ধ করতে নয়, আত্মরক্ষার জন্যে, কে কখন পদধূলি নিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে ঠ্যাং টেনে দেবে বিশ্বাস কী? অশিক্ষিত দেশ, ইতর জনগণ।

তবে, মুখ্যুগুলোকে ভালবেসে সুখ আছে। এদের কুসংস্কারে জবজবে হৃদিবান্ডিল থেকে যে অন্ধ আনুগত্য আর পেন্নাম নির্গত হয়, ওয়াঃ। রিটার্নে আমি দিচ্ছি কত তা-ও দ্যাখো! প্রার্থনা করলে ক্যানসার সেরে যায়, আমি না বললে কেউ জানত? হরেক অসুখ সারাই, স্রেফ আশীর্বাদ করে। হ্যাঁ, আশ্রমে এক্স-রে মেশিনও আছে, ছোট অপারেশন থিয়েটারও আছে, গাদা গাদা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ রোজ সাপ্লাই আসে, সেগুলো দিয়েও চিকিচ্ছে করি। কিন্তু রোগ সারে, ওই যে বললাম, আশীর্বাদে। বাকিগুলো টুকটাক টোটকা। তা, ঈশ্বরের কোলে বসে যে লোকটা ছিটিয়ে যাচ্ছে হাইজিনিক চরণামৃত, তাকে ভক্তরা জাপটে ভালবাসবে না?

এই ভক্তের ভালবাসাই তো আসলি ফ্যাক্টর রে। ভক্ত আর ভগবান, কার বাঁধনে কে অসহায় হয়ে পা ছটকাচ্ছে, বোঝার জো নেই। আমি বাড়ির পাশে অত্তবড় সুইমিং পুল করলেম, বাড়ির আঠেরোটা ঘরেই এসি লাগালেম, মার্সিডিজ বিএমডব্লিউ লড়ালেম, আমায় দুধ দিয়ে চান করিয়ে সেই দুধের ক্ষীরে প্রসাদ বানিয়ে গপগপাতে বললেম, সবই ভক্তদের আদেশে। ওরা আমায় তকতকে হিরোমাফিক দেখে খুশি হয় যে। আমার সেই পনেরো হাজার সন্তান যখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাদের বাবাকে বাঁচাতে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে যায়, বুক পেতে দেয় শয়তান পুলিশের অত্যাচারের সামনে, অ্যাসিড গুলি ঢিল ছুড়ে ফাটিয়ে দেয় আইনের মাথা, আমি চল্লিশ বার শমন ফেরানোর পর বলে একচল্লিশেও লাত্থি মারি, আমি যত ফুকারি ‘পাগলার দল, সর, সারেন্ডার করব’, তত বার আমায় পিছমোড়া বেঁধে ‘তোর আগে আমি মরব রে প্রভু প্লাস প্রিয়’ জপে কুঠুরিতে কিডন্যাপ রাখে, তখন আমার করার কী আছে বল? এই তো ক’দিন আগে যখন আমার হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল একটা কোর্টে, ভক্তরা শুধু পালে পালে সেই চত্বর জ্যাম করেই ছাড় দেয়নি, কয়েকটা উকিল ত্যান্ডাই করেছিল বলে, গোটা জায়গাটায় তারা পালে পালে বিষ্ঠা ত্যাগ করে এসেছিল। এই সহসা সমবেত মলত্যাগ কি এমনি এমনি হয়? আসলি ভক্তির জোলাপ লাগে।

নিন্দুকরা বলছে, আমার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী নিরীহ গেঁয়ো ভক্তগুলোকে দাবড়েছিল: মানুষ-ঢাল হয়ে না দাঁড়ালে গুলি করে মারবে, ওদের জিনিসপত্তর কেড়ে রেখে দিয়েছিল— যাতে ওরা বাধ্য হয়ে আমার হয়ে লড়ে, কেউ যাতে আশ্রম থেকে বেরতে না পারে তাই জঙ্গি দারোয়ানি বাগিয়েছিল। বেশ তো, তা-ই সই। ছোট ছেলেকে কি ইশকুলে জোর করেই বসিয়ে রাখতে হয় না? চিলুবিলু পিটিয়ে দিনে ষোলো ঘণ্টা প্র্যাকটিস করালে তবেই কি সেতারিয়া বড় হয়ে ওয়ার্ল্ড কাঁপায় না? আমার সন্তানদের ভয় কাটিয়ে প্রকৃত কর্তব্যের টানেলে ঠুসে দেওয়া, আদর্শের জন্যে স্যাক্রিফাইস করার প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় ঠেলে দেওয়া কি আমার কাজ নয়? ভক্তিমার্গ শুধু কেত্তন শুনে দুলুনির পথ নয় বাপ, ওতে ক্যারাটে-কুংফুও লাগাতার উঁকি মারে! চারটে না পাঁচটা লোক মারা গেছে, যাক না, দেশের সৈন্যরাও কি সেধে মরে? রাষ্ট্র তাদের ঘাড়ে ধরে পাঠায়। আর রাষ্ট্রপতি কী করে? কপ্টারে চড়ে আকাশে বসে কাঁপে। কারণ তার বাঁচাটা বৃহত্তর প্রয়োজন। আমি সেই মডেলই মেনেছি। মরাগুলোকেও বাঁচাতে পারতাম, পুলিশ আশীর্বাদই করতে দিল না!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE