Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অন্ধ এবং ভ্রান্ত

ভারতীয় টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা ‘পাকিস্তানের পুত্রবধূ’, অতএব তাঁহাকে ভারতের নূতন অঙ্গরাজ্য তেলঙ্গানার ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ নিয়োগ করা অনুচিত— বিজেপি নেতা কে লক্ষ্মণের এই উক্তিকে ‘অমৃতং বালভাষিতম্’ বলা চলে না। লক্ষ্মণ প্রাপ্তবয়স্ক রাজনীতিক। সানিয়া নিজে এই বক্তব্যে স্বভাবতই বিরক্ত। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়া তিনি জানাইয়াছেন, পাক ক্রিকেটারকে বিবাহ করিলেও তিনি প্রথমত হায়দরাবাদি ও ভারতীয়, আমৃত্যু তাহাই থাকিবেন।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:৫০
Share: Save:

ভারতীয় টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা ‘পাকিস্তানের পুত্রবধূ’, অতএব তাঁহাকে ভারতের নূতন অঙ্গরাজ্য তেলঙ্গানার ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ নিয়োগ করা অনুচিত— বিজেপি নেতা কে লক্ষ্মণের এই উক্তিকে ‘অমৃতং বালভাষিতম্’ বলা চলে না। লক্ষ্মণ প্রাপ্তবয়স্ক রাজনীতিক। সানিয়া নিজে এই বক্তব্যে স্বভাবতই বিরক্ত। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়া তিনি জানাইয়াছেন, পাক ক্রিকেটারকে বিবাহ করিলেও তিনি প্রথমত হায়দরাবাদি ও ভারতীয়, আমৃত্যু তাহাই থাকিবেন। তাঁহার মর্মবেদনা অনুভব করা হয়তো লক্ষ্মণদের পক্ষে সম্ভব নয়। সানিয়া আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করিয়া থাকেন, দেশকে অনেক সম্মানও তিনি আনিয়া দিয়াছেন। বিদেশে অনেকে ভারতকে সানিয়া মির্জা মারফতই চেনে, চিনিবেও, লক্ষ্মণাদি মারফত নয়।

লক্ষ্মণের এই অসংবেদী উক্তি অবশ্য তাঁহার দল সমর্থন করে নাই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর জানাইয়াছেন, ইহা দলের মতও নয়, কারণ সানিয়া কার্যত সমগ্র ভারতেরই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসক দলের সরকারি অবস্থান কিংবা আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মধ্যে প্রায়শ দেশময় ঘনাইয়া ওঠা তীব্র সমালোচনার ধাক্কা সামাল দিবার তাগিদ থাকে। সেই তাগিদকে ছাপাইয়া যে গুরুতর প্রশ্নটি উঠিয়া পড়ে, তাহা হইল, এ ধরনের বেফাঁস মন্তব্য কি নিছকই কোনও ব্যক্তি-রাজনীতিকের খামখেয়াল, না কি তাহার নেপথ্যে রহিয়াছে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাধি, যাহা দীর্ঘ কাল ধরিয়া মৌলবাদী হিন্দুত্বের প্রশিক্ষণে সযত্নে লালিত হইয়াছে। বিস্তৃত সংঘ পরিবারের বিভিন্ন অঙ্গের চেতনায় এই সংকীর্ণতার প্রভাব প্রকট। অতঃপর সেই শিক্ষায় সুশিক্ষিত হইয়া পড়ুয়ারা যখন রাজনীতির বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করেন, তখন থাকিয়া-থাকিয়াই গণতান্ত্রিক রাজনীতির আড়াল হইতে ওই সকল ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়া যায়। ইহাকে আকস্মিক ‘বলিয়া ফেলা’ কথা ভাবা কঠিন।

এই মানসিকতার প্রধান সমস্যা, ইহা ব্যক্তিকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে শেখে নাই। বিশেষত, মেয়েদের। এই প্রাচীন ধারণার কাঠামোয় মেয়েরা বিবাহের পরে পতিগৃহের পরিচয়েই পরিচিত, তাহাই মেয়েদের একমাত্র পরিচয়। সুতরাং, সানিয়া মির্জা ভারতীয় হইলেও পাকিস্তানি পুরুষের সহিত বিবাহের ফলে তিনি পাকিস্তানি হইয়া যান। নারীর অবস্থান ও পরিচিতি সম্পর্কে এই প্রাচীন ধারণার সহিত মিশিয়া যায় জাতীয়তাবাদের আধুনিক ধারণা, যাহা পাকিস্তানকে ভারতের ‘শত্রু’ হিসাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করে। এই ‘আধুনিক’ জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিতে দুই রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিরোধিতা দুই দেশের শত্রুতা হিসাবে গণ্য হয়, সন্ত্রাসের কারবারিরা জনসাধারণের প্রতিভূ হইয়া ওঠে। ইহারই পরিণাম ‘পাকিস্তানের পুত্রবধূ’কে ভারতের বৈরী হিসাবে গণ্য করিবার মানসিকতা। অবশ্য লক্ষ্মণের বক্তব্য শুনিয়া অন্য এক ইতিহাস মনে পড়িতে পারে। তিনি হয়তো ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার দল এক সময় রাজীব-জায়া সনিয়া গাঁধীকে ভারতীয় বধূ রূপে শিরোধার্য করিতে সম্মত ছিলেন না। তাঁহাকে ‘ইতালিপুত্রী’ আখ্যা দিয়া তাঁহার বিদেশিনিত্ব প্রতিপন্ন করিতে দল হিসাবে বিজেপি একদা প্রবল উৎসাহী ছিল, তাহার রাজনৈতিক প্রচারেও বিষয়টি প্রাধান্য পায়। অথচ এখন প্রবীণ দলনেতা সানিয়া মির্জাকে ‘ভারতপুত্রী’ বলিয়া মানিতে নারাজ। ইহাকে এক যাত্রায় পৃথক ফল বলা যায়, সুবিধাবাদী রাজনীতি বলিলেও ভুল হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE