রণক্ষেত্রে অনেক বেপরোয়া ঘটনা ঘটে থাকে। নিরীহ সাংবাদিকও তার শিকার হতে পারেন। যুদ্ধে নিয়ম নাস্তি। কিন্তু যেখানে যুদ্ধ নেই, জনবিক্ষোভ নেই তেমন আপাত শান্তির পরিবেশেও ঘাতকেরা লুকিয়ে থাকে সাংবাদিক নিধনের জন্য।
গত ২৭ মে ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় খালিকোট শহরে ২৯ বছরের টিভি সাংবাদিক তরুণকুমার আচার্য খুন হয়ে গেছেন আততায়ীদের হাতে। তাঁকে কারা মারল, কেন মারল তার কোনও বিস্তারিত তথ্য আজও জানা যায়নি। সংবাদের জলপ্রপাত ঠেলে বিগত তিন মাসে মৃত তরুণ আর এক দিনের জন্যও মিডিয়ায় ঠাঁই করে নিতে পারেনি। গত মাসে সাবেক বর্মার একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-সহ চার সাংবাদিককে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পত্রিকাটা বন্ধ হয়েছে এক মাস আগেই। তাতে সংবাদ বেরিয়েছিল যে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি বিরাট ভূখণ্ড দখল করে সেনাবাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র কারখানা তৈরি করছে। প্রাণে না-মেরেও হাত থেকে কলম কেড়ে নেওয়ার এমন নজির দিনে দিনে বাড়ছে। মায়ানমারে নাকি এখন গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। বাতাস বইলেই যে বাহানা বদলায় না, তার সর্বশেষ নজির মিশর। আরব বসন্তের ঢেউ স্তিমিত হওয়ার পর গত জুন মাসে সেখানে আল-জাজিরা চ্যানেলের তিন সাংবাদিককে কোনও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়াই দশ বছরের জন্য জেলে পোরা হয়েছে। পাকিস্তানে জঙ্গি সংগঠন তেহরিক এ-তালিবান ইতিমধ্যে হত্যা-তালিকা তৈরি করে ফেলেছে সাংবাদিক এবং মিডিয়া মালিকদের। গত ছয় বছরে গড়ে মাসে এক জন করে সাংবাদিক প্রাণ দিচ্ছেন ওই দেশে।
পাকিস্তান নিন্দিত হলে এ দেশে অনেকে একটু আহ্লাদিত হন। কিন্তু ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, পরিস্থিতিটা আমাদের পক্ষেও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গত বছর সারা পৃথিবীতে সাংবাদিক খুন হয়েছেন মোট ১১৭ জন। তার মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া এবং ইরাকে যথাক্রমে ১৬ এবং ১৩ জন। তেমন যুদ্ধের ঘনঘটা না-থাকলেও ফিলিপিন্সেও প্রাণ দিয়েছেন ১৩ জন। তার পরেই ভারতের স্থান। মৃত সাংবাদিকের সংখ্যা ১১। পাকিস্তানে কিন্তু মারা গেছেন ৯ জন সাংবাদিক।
কী ধরনের পরিস্থিতিতে ভারতের সাংবাদিক খুনের ঘটনাগুলি ঘটে? দু’একটা দৃষ্টান্ত। মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার ছবি তুলতে গিয়ে খুন হন একটি টিভি চ্যানেলের চিত্রগ্রাহক। ওই সময়েই প্রাণ দিতে হয় এক স্থির-চিত্রগ্রাহককেও। ছত্তীসগঢ়ে বস্তার জেলায় দুটি পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি সকালে বাজার করতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। অভিযোগের তির মাওবাদীদের দিকেই ছিল। কিন্তু প্রচারপত্র বিলি করে তারা জানায় যে, তাঁরা কখনও শেমি চাঁদকে শ্রেণিশত্রু বলে মনে করেননি। কিন্তু বস্তারের দ্বিতীয় একটি সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় মাওবাদীরা তার দায় স্বীকার করে। সাংবাদিক বিতর্কিত হয়ে দাঁড়ান, কারণ মাওবাদীদের চোখে তিনি শ্রেণিশত্রু এবং পুলিশের চোখে তিনি মাওবাদীদের আড়কাঠি। জলন্ধরের এক সাংবাদিক বালি মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে যে দিন স্থানীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সে দিনই বালিবাহী ট্রাকের ধাক্কায় তাঁর মৃত্যু হয়। প্রসঙ্গত, রাশিয়ায় ককেশাস অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকায় আঞ্চলিক প্রশাসন কেমন করে রাষ্ট্রের জমি বিলিয়ে দিচ্ছে অন্যের হাতে তা নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করার পরেই প্রকাশক খুন হয়ে যান।
লক্ষণীয়, এই সব ঘটনা ঘটেছে মেট্রোপলিটন থেকে অনেক দূরে বিভিন্ন দূরবর্তী জেলায়। এঁদের কাউকেই সরাসরি রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী বা পুলিশ খুন করেনি। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের বাইরেও অনেক মহল তৈরি হয়েছে যারা নির্ভীক সাংবাদিকতাকে সহ্য করতে পারছে না। তবে, রাষ্ট্র যেমন তাদের খুন করেনি তেমনই তাদের সুরক্ষাও দিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, আক্রান্তরা অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার প্রতিনিধি নন। তা হলে কি তৃণমূল স্তরের সাংবাদিকতাই প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে? কোনও সহজ উত্তর নেই। এমন জিজ্ঞাসার কোনও সহজ সমাধান নেই। এই বিষয়ে অবশ্যই আরও নানাবিধ মত-বিনিময় প্রয়োজন। তবে এ কথা অতি বিস্ময়ের সঙ্গে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, সেলেব্রিটি সাংবাদিকরা সহজ আয়াসে ক্ষমতার অলিন্দে কোলাকুলি করার সুযোগ পান যথেষ্ট নিরাপত্তা-বেষ্টনীর মধ্যে, কিন্তু দূরতম প্রান্তে যাঁরা অনাচারের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান তাঁদের কার্যত তাদের সুরক্ষিত করার কেউ নেই।
কেন নেই? ভারত কোনও ঘোষিত যুদ্ধে জড়িত নয়। এই দেশে এমন কিছু ঘটেনি যাতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়। এমন অবস্থায় এক বছরে তা হলে ১১ জন সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হবে কেন? বহুকাল ধরেই শুনে আসছি শক্তিমান মিডিয়া গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যই প্রমাণ করে। কিন্তু গত এক বছরের ঘটনা দেখিয়ে দেয়, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্র সেই অসহিষ্ণুতাকে প্রাপ্য শাস্তি দিতে নারাজ। গত ১০ বছরে আমাদের দেশে অন্তত ৭০ জন কর্মরত সাংবাদিক খুন হয়েছেন। প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এই খতিয়ান দিয়ে জানাচ্ছে যে তার একটি ক্ষেত্রেও আজ পর্যন্ত এক জনেরও কোনও সাজা হয়নি। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে এই পরিসংখ্যান গৌরবের নয়।
দূরদর্শনের প্রাক্তন সংবাদ প্রযোজক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy