Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অবৈধ, অবৈধই

কলিকাতা হাইকোর্ট জানাইয়া দিয়াছে, শহরে গড়িয়া ওঠা বেআইনি নির্মাণকে জরিমানা লইয়া আইনসিদ্ধ করার এক্তিয়ার কলিকাতা পুরসভার নাই। হাইকোর্টকে কেন এই মর্মে রায় দিতে হইবে, কেন বেআইনি নির্মাণ এমনিতেই ভাঙিয়া ফেলা হইবে না, আপাতদৃষ্টিতে তাহা বুঝা কঠিন। কিন্তু কলিকাতা ও শহরতলিতে, বস্তুত গোটা রাজ্যেই বেআইনি নির্মাণ একপ্রকার দস্তুর হইয়া পড়িয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০০:১২
Share: Save:

কলিকাতা হাইকোর্ট জানাইয়া দিয়াছে, শহরে গড়িয়া ওঠা বেআইনি নির্মাণকে জরিমানা লইয়া আইনসিদ্ধ করার এক্তিয়ার কলিকাতা পুরসভার নাই। হাইকোর্টকে কেন এই মর্মে রায় দিতে হইবে, কেন বেআইনি নির্মাণ এমনিতেই ভাঙিয়া ফেলা হইবে না, আপাতদৃষ্টিতে তাহা বুঝা কঠিন। কিন্তু কলিকাতা ও শহরতলিতে, বস্তুত গোটা রাজ্যেই বেআইনি নির্মাণ একপ্রকার দস্তুর হইয়া পড়িয়াছে। পুরসভারই একটি সূত্র অনুযায়ী ফি-বছর এই শহরে অন্তত সাড়ে তিন হাজার বাড়ি বেআইনি ভাবে নির্মিত হইতেছে। অতঃপর নির্মাতাদের নিকট মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় করিয়া ওই সব নির্মাণকে বৈধতার শংসাপত্র দেওয়া হইতেছে। পুর আইনে এ ধরনের কোনও ছাড়পত্র মঞ্জুর করার বিধান না থাকিলেও নিত্য এই অপকর্মটি পুরসভার সহিত যোগসাজশেই ঘটিয়া চলিয়াছে। ইহা সরাসরি দুর্নীতি। হাইকোর্ট তাই ওই বেআইনি নির্মাণ ভাঙিয়া ফেলার নির্দেশ দিয়াছে।

বেআইনি কাজকে আইনসম্মত করার আরও অনেক নজির সৃষ্টি করা হইয়াছে। যেমন কলিকাতায় চলাচলকারী ত্রিশ হাজার লাইসেন্সবিহীন অটো-রিকশকে (পরিবহণ মন্ত্রীর নিজস্ব খতিয়ান অনুযায়ী) শহরের পথে যাত্রী পরিবহণ করিতে দেওয়া হইতেছে। রাজ্য জুড়িয়া মফস্সল শহরে ‘ভ্যানো’ নামক কাটা তেলে চলা দূষণকারী, বেআইনি যানকেও ছাড়পত্র দেওয়া হইয়াছে। ফুটপাথ উপচাইয়া শহরের প্রধান সড়কগুলি হকারদের জবরদখল করিতে দেওয়া হইতেছে। অবৈধ ক্রিয়াকলাপকে বৈধ করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জুতসই অজুহাতও খাড়া করিয়াছে: প্রথাগত ভাবে এমনটাই দীর্ঘ কাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে। অন্য কেহ নহেন, স্বয়ং পুরসভার মহানাগরিকের মুখেই এমন অমৃতভাষণ শুনা গেল। দীর্ঘ কাল চলিয়া আসিতেছে বলিয়াই একটি কুপ্রথাকে শিরোধার্য করিতে হইবে? সমাজের ক্ষেত্রে এই কুযুক্তি সম্প্রসারিত করিলে তো দীর্ঘ কাল চলিয়া আসা সতীদাহ, বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহকেও শিরোধার্য করিতে হইত। সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যেমন প্রচলিত কুপ্রথা রদ করিতে হয়, তেমনই জরিমানা লইয়া নিয়মবিরুদ্ধ অপকর্মকে চালু রাখার প্রবণতাও বন্ধ করিতে হয়। জরিমানা দিয়া অবশ্য এই রাজ্যে গণধর্ষকরা সালিশি সভায় অব্যাহতি পাইয়া থাকে। এই যুক্তিতে তো খুন করিয়াও নিহতের পরিবার কিংবা সালিশিকারী দলীয় পঞ্চায়েতকে ‘পর্যাপ্তজরিমানা’ দিয়া খুনি আইনের নাগাল এড়াইতে পারে! যাহারা অপকর্মে লিপ্ত হয়, তাহারা অবশ্যই জরিমানা দিয়া সাধু সাজিতে চাহিবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনিক, পুর বা সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন, কোন যুক্তিতে এই অবিচারের পৃষ্ঠপোষকতা করে?

অবৈধের বৈধায়নের পিছনে একটি গূঢ়তর কারণ আছে। কলিকাতা পুরসভা যে গত বছরেই এই বাবদে ৬৫ কোটি টাকা আয় করিয়াছে, তাহাতেই স্পষ্ট, জরিমানার অঙ্কটি লোভনীয় না হইলে কর্তৃপক্ষ সহজে বেআইনিকে আইনি করেন না। তবে প্রথমেই যেখানে আইনভঙ্গকারীকে গ্রেফতার করিয়া বিচারের কাঠগড়ায় তোলা উচিত, সেখানে পুলিশ বা প্রশাসন যে হাত গুটাইয়া থাকে, তাহার কারণ স্থানীয় রাজনীতির চাপ। কাউন্সিলর কিংবা বিধায়ক, ক্ষেত্রবিশেষে সাংসদরাও আইনভঙ্গকারীর হইয়া কর্তৃপক্ষের কাছে ওকালতি করায় পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষে আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ কার্যত অসম্ভব হইয়া পড়ে। রাজনীতিকদের তাই অসাধু প্রোমোটার-ডেভেলপারদের হইয়া সালিশি বন্ধ করিতে হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE