মানুষ নাকি জীবনে এক বারই রেস খেলিতে যায়। পরে যত বার যায়, তাহা শুধু লোকসানটুকু পুষাইয়া লইতে! আচরণভিত্তিক অর্থনীতির (বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স) তাত্ত্বিকরা বলেন, মানুষ লোকসানকে ডরায়। লাভে যতখানি খুশি হয়, লোকসানে তাহার অনেক বেশি দুঃখিত হয়। ফলে, লোকসান পুষাইয়া লওয়ার প্রবণতাও অদম্য। যে কারণে মানুষ ডুবিতে বসা ব্যবসা হইতে সরিয়া আসিবার বদলে নূতন করিয়া টাকা ঢালিতে থাকে, সেই কারণেই ভাঙিয়া যাওয়া সম্পর্কও ছাড়িতে পারে না, আঁকড়াইয়া থাকে। ছাড়িয়া দিলে প্রাথমিক লগ্নিটি যে জলে যায়। সেই লোকসান ঠেকাইতে মানুষ নূতনতর লোকসানের পথেই হাঁটে। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যে মনুষ্যসুলভ এই একটি গুণ নাই, তাহা বলা যাইবে না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনমাসব্যাপী কুনাট্য প্রমাণ করে, বিজেপি-ও প্রাথমিক বিনিয়োগের লোকসান ঠেকাইতে মরিয়া। প্রেম নহে, নিঃসন্দেহে, কিন্তু ব্যবসা বটে— গেরুয়া জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার বেসাতি। কানহাইয়া-উমর-অনির্বাণের পুলিশি হয়রানি, ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ যখন গোটা দুনিয়ায় তিরস্কৃত হইল, তখন সেই বেসাতির আশা ছাড়িয়া হাত গুটাইয়া লওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। বোঝা উচিত ছিল যে জেএনইউ হজম করা নাগপুরের কাজ নহে। কিন্তু, মনুষ্যচরিত্র! নরেন্দ্র মোদীরা কুনাট্যের মাত্রা বাড়াইয়াই চলিলেন। তাঁহারাই যন্ত্রী, উপাচার্য যন্ত্রমাত্র। উমর-অনির্বাণের বহিষ্কারের নির্দেশের প্রতিবাদে যখন ছাত্র-শিক্ষকরা অনশনে বসিয়াছেন, যন্ত্রীরা তখনও থামিলেন না। যন্ত্রও বাজিয়া চলিতেছে। লোকসানের খাতা যে উপচাইয়া পড়িতেছে, সে দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত নাগপুরের নাই।
আফজল গুরুর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা করা কেন অন্যায়, তাহার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ শোনা যায় নাই। অন্যায় হইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তাহার বিচার করিতে পারিত। তাহার পরিবর্তে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকিয়া, দেশদ্রোহের তকমা লাগাইয়া, ছাত্রদের গ্রেফতার করিয়া রাজনাথ সিংহরা যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। বিষয়টি আপাতত আদালতের বিচারাধীন। অভিযুক্ত তিন ছাত্রই জামিনে মুক্ত। এই অবস্থায় জেএনইউ কর্তৃপক্ষ ফের শাস্তি ঘোষণা করিয়া দিলেন। তাঁহারাই যে ঘটনাকে আদালতের বিচার্য জ্ঞান করিয়াছেন, সেখানে ফের সাজা ঘোষণা করা চলিতে পারে কি? এক ‘অপরাধ’-এ দুই বার শাস্তি হয় না। ছাত্র-শিক্ষকদের অনশনও তাঁহারা না-দেখিয়া থাকা মনস্থ করিয়াছেন। চক্ষুলজ্জার খাতিরে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সহিত আলোচনায় বসিয়াছেন বটে, কিন্তু সেই চীরে লজ্জা নিবারণ হইতেছে না। দৃশ্যত, মোদীরা যুদ্ধটি চালাইয়া যাইতে চাহেন।
কোথায় থামিতে হয়, তাহা না জানিলে যারপরনাই নাস্তানাবুদ হইবার সম্ভাবনা বিপুল। নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয়ই বুঝিতেছেন। এই অসম যুদ্ধের প্রতি ধাপেই স্পষ্ট, জেএনইউ-এর ছাত্রদের সহিত আঁটিয়া উঠার সাধ্য নাগপুরের নাই। যুদ্ধটি অসম, কারণ তাহা মেধা বনাম উগ্রপন্থার যুদ্ধ। বিজেপি যখন ভারতমাতার দেবীমূর্তি কল্পনা করিতে ব্যস্ত, জেএনইউ-এর ছাত্ররা তখন জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন দিক লইয়া ভাষণের আয়োজন করিয়াছেন। রাজনাথ সিংহের স্নেহধন্য আইনজীবীরা যখন কানহাইয়া কুমারের উপর ঝাঁপাইয়া পড়াকেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা জ্ঞান করিয়াছেন, জেএনইউ-এর ছাত্ররা তখন সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল গাঁথিয়াছেন। ধর্মনিরপেক্ষ উদারতার যে ধারণাটির নাম জেএনইউ, নাগপুরের দেশপ্রেমের হাতিয়ারে তাহাকে পরাস্ত করা অসম্ভব। এই কথাটি মানিতে নরেন্দ্র মোদীরা দৃশ্যত নারাজ। কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে কোন পক্ষের পরাজয় সর্বদাই নিশ্চিত, তাঁহারা এখনও জানেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy