Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য যা করা দরকার

অসংগঠিত ক্ষেত্র বিশ্ব অর্থনীতির একটি খুব বড় অংশ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন-এর তথ্য অনুযায়ী, আনঅর্গানাইজড তথা ইনফর্মাল সেক্টর প্রায় সব ক্ষেত্রেই তুলনায় অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত। এবং কৃষিকে এর পরিধির বাইরে রাখাই দস্তুর। বিভিন্ন দেশের কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান থেকে যে-চিত্র পাওয়া যায়, সেটা মোটামুটি এই রকম: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন ও পরিষেবার পরিসরে।

মহানাগরিক। কলকাতা, ২০১২। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

মহানাগরিক। কলকাতা, ২০১২। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

বিশ্বজিৎ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

অসংগঠিত ক্ষেত্র বিশ্ব অর্থনীতির একটি খুব বড় অংশ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন-এর তথ্য অনুযায়ী, আনঅর্গানাইজড তথা ইনফর্মাল সেক্টর প্রায় সব ক্ষেত্রেই তুলনায় অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত। এবং কৃষিকে এর পরিধির বাইরে রাখাই দস্তুর। বিভিন্ন দেশের কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান থেকে যে-চিত্র পাওয়া যায়, সেটা মোটামুটি এই রকম: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন ও পরিষেবার পরিসরে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনুপাতটা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ, আফ্রিকাতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশে ৫৫ শতাংশ, এমনকী ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলিতেও কিছু কর্মসংস্থানের সুরাহা হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে। দক্ষিণ ইউরোপে ২৪ শতাংশ, পশ্চিম ইউরোপে ১০ শতাংশ, কানাডায় ১৮ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪ শতাংশ। জাম্বিয়াতে মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশ, উগান্ডায় ৮৪ শতাংশ, তাইল্যান্ডে ৭২ শতাংশ, নেপালে ৭৩ শতাংশ, লিথুয়ানিয়ায় ৭১ শতাংশ, ঘানায় ৭৯ শতাংশ কর্মসংস্থান আসে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মাধ্যমে। আর ভারত? যদি কৃষিক্ষেত্রকে বাদ দেওয়া হয়, তা হলে ভারতের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৬০ শতাংশের বেশি।

সাধারণ ভাবে বললে, অসংগঠিত ক্ষেত্র সরকারি বিধিবদ্ধ আইনের আওতার বাইরে থাকে। এই ক্ষেত্রের লোকেরা যেহেতু সরকারি পরিষেবা, যেমন জল, বিদ্যুৎ, ফুটপাত প্রভৃতি ব্যবহার করার প্রতিদানে সরকারকে প্রাপ্য কর প্রদান করে না, সরকারও এদের কোনও সমস্যার ব্যাপারে আইনত দায়বদ্ধ থাকে না। এই সুযোগে পাড়ার তোলাবাজ, রাজনৈতিক দাদা এমনকী পুলিশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত মানুষকে হেনস্থা করার সুযোগ পায়। একটু অন্য ভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, সমাজের একটি শ্রেণির মানুষ ভয় দেখিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে প্রাত্যহিক বা সাপ্তাহিক বা মাসিক তোলা আদায় করে। তারা আশ্বাস দেয় যে, যে-কোনও ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ, যেগুলি তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে, সেগুলিকে তারা বন্ধ রাখবে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রকে জিইয়ে রাখার ব্যাপারে তোলাবাজদের একটা নিজস্ব তাগিদও থাকে। কারণ, অসংগঠিত ক্ষেত্র টিকে না থাকলে তাদের ‘রোজগার’-এর রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক নেতা ও তোলাবাজ বা মস্তানদের মধ্যে একটি অশুভ আঁতাঁত গড়ে ওঠে, যেটি কোনও মতেই অভিপ্রেত নয়।

এ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে তোলাবাজির পরিমাণ কেমন? তিনটি প্রধান শহরের আংশিক তথ্য দেখলেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড় হয়। দিল্লির রিকশাওয়ালা ও হকাররা প্রত্যেক মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো অর্থ নেতা, দাদা বা পুলিশকে ঘুষ বা তোলা হিসেবে জমা দেয়। মুম্বইতে এর পরিমাণ কিছুটা কম, প্রায় ৩৫ কোটি টাকার মতো। আর কলকাতার হকাররা গড়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে তোলাবাজ বা পুলিশকে দিতে বাধ্য থাকে। উল্লেখ্য, কলকাতার হিসেবের মধ্যে লাইসেন্সহীন অটো রিকশা, টানা-রিকশাওয়ালাদের ধরা হয়নি। এদের অন্তর্ভুক্ত করলে পরিমাণটা কলেবরে বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পাবে।

অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং তোলাবাজির এই সম্পর্ক বড় রকমের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যারা তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রায় কোনও রকম কাজকর্ম না করেই মাস শেষে মোটা টাকা রোজগার করে। আর, কে না জানে যে হাতে কাঁচা টাকার জোগান থাকলে এবং নির্দিষ্ট কোনও কাজ করার দায় না থাকলে নানা রকম অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। অন্য দিকে, এর আর একটা পরোক্ষ কুফলও পড়ে সমাজের উপরে। আপনার বাড়ির ছেলেটি দিন-রাত প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে তার মাসিক দিন গুজরানের ব্যবস্থা করে আর লক্ষ করে যে, পাশের বাড়ির টাট্টু দাদা বাইক হাঁকিয়ে সকালে বেরিয়ে যায় আর সারা দিন ফুর্তি করে, তোলা আদায় করে দিনশেষে এককাঁড়ি টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। এ ভাবে চলতে চলতে আপনার বাড়ির ছেলেটি যদি এক দিন বিগড়ে যায়, তখন কি সেটাকে খুব অন্যায় বলা যাবে?

একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের পক্ষে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এতে অসংখ্য পরিবারের দু’মুঠো অন্নের সংস্থান বন্ধ হবে, যদি না সরকার কোনও বিকল্প কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করে। এমন একটি পন্থা বার করতে হবে, যাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রও থাকবে, আবার একই সঙ্গে সরকারি পরিষেবা ব্যবহার করার বিনিময়ে সরকারি কোষাগারে কিছু অর্থেরও সমাগম হবে, তোলাবাজিও বন্ধ হবে। যারা তোলাবাজি করে, তাদের পুনর্বাসনেরও একটা বন্দোবস্ত সম্ভব। এ ধরনের নীতি মরক্কো, ঘানা, সেনেগাল, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো দেশে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই চালু হয়েছে, সুফলও মিলছে।

সংক্ষেপে এই বন্দোবস্তের একটা রূপরেখা দেওয়া যেতে পারে। এর কয়েকটি দিক আছে। এক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজের সময় এবং অঞ্চল ঠিক ভাবে নির্বাচন করে ব্যবসার সময় নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিতে হবে। দুই, বিভিন্ন এলাকাতে সমগোত্রীয় দ্রব্য বিক্রেতাদের কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে ক্রেতারা দ্রব্যের দাম ও গুণ সহজেই তুলনা করতে পারবেন, অপর দিকে জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজেও সুবিধা হবে। তিন, বিক্রেতাদের ছোট ছোট ভ্যান-ট্রলি প্রয়োজনে সরকারি বা পুর উদ্যোগে জোগান দিতে হবে, যাতে দিনের নির্দিষ্ট সময় শেষে সমস্ত মালপত্র গুটিয়ে নিতে সমস্যা না হয় এবং রাস্তার দু’পাশও পরিষ্কার থাকে। চার, প্রত্যেক বিক্রেতাকে সরকারি বা আধা-সরকারি ভাবে ছ’মাস বা এক বছরের জন্য ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট এবং যথাযথ হারে ‘ফি’ সংগ্রহ করতে হবে। পাঁচ, নির্ধারিত সময় অন্তর ব্যবসার অনুমতি পুনর্নবীকরণ করতে হবে, প্রয়োজনে নতুন ব্যবসায়ীদেরও সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পুনর্নবীকরণের পদ্ধতির মাধ্যমে এটাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে যে, কেউ যেন নিজের লাইসেন্স অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করতে না পারেন। কারও কার্যপদ্ধতি, আচার-আচরণ যথাযথ না হলে তাঁর লাইসেন্স বা অনুমতি বাতিল করার সুযোগ থাকবে। ছয়, সরকারের সংগৃহীত অর্থের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহার করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দুর্ঘটনা এবং স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থাও করা সম্ভব। সাত, এর পরেও যদি কেউ তোলাবাজের খপ্পরে পড়েন, তা হলে

বিশ্বভারতীতে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

biswajit mondal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE