Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আজব (নৈ)রাজ্য

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গকে রাজ্য না বলিয়া মূর্তিমান নৈরাজ্য বলাই যুক্তিযুক্ত। আজব নৈরাজ্য। এখানে ধর্ষণকে ‘সাজানো ঘটনা’ আখ্যা দিয়া ধর্ষিতাকে দিব্য অপমান করা হয়। অথচ যাঁহারা সেই অপকর্মটি করেন, তাঁহাদের আচরণ দেখিয়া মনে হয়, তাঁহারা নিয়মিত ঘটনা সাজাইবার কাজেই লিপ্ত। আলিপুরের পুলিশি কুনাট্যকে তেমনই এক সাজানো ঘটনা বলিয়া মনে করিবার প্রভূত কারণ এবং যুক্তি রহিয়াছে।

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গকে রাজ্য না বলিয়া মূর্তিমান নৈরাজ্য বলাই যুক্তিযুক্ত। আজব নৈরাজ্য। এখানে ধর্ষণকে ‘সাজানো ঘটনা’ আখ্যা দিয়া ধর্ষিতাকে দিব্য অপমান করা হয়। অথচ যাঁহারা সেই অপকর্মটি করেন, তাঁহাদের আচরণ দেখিয়া মনে হয়, তাঁহারা নিয়মিত ঘটনা সাজাইবার কাজেই লিপ্ত। আলিপুরের পুলিশি কুনাট্যকে তেমনই এক সাজানো ঘটনা বলিয়া মনে করিবার প্রভূত কারণ এবং যুক্তি রহিয়াছে। অভিযোগ, থানায় হামলাকারী শাসক-আশ্রিত সমাজবিরোধীদের আড়াল করিতে দশ-পনেরো কিলোমিটার দূর হইতে কিছু গোবেচারা নিরীহ মানুষকে ধরিয়া আনিয়া আদালতে পেশ করা হইয়াছে, তাহার আগে আদালতে মুখ খুলিলে আরও গুরুতর অভিযোগে ফাঁসাইয়া দিবার হুমকি দেওয়া হইয়াছে। বিচারপতিরা ধৃতদের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে তাহাদের পত্রপাঠ ছাড়িয়া দিলে এই অভিযোগের গুরুত্ব অনুমান করিতে অসুবিধা হয় না। অভিযোগ, থানায় হামলাকারী দলীয় দুষ্কৃৃতীরা থানায় বসিয়াই দারোগার সহিত শলা করিয়া এই কুনাট্যের মহড়া সাজাইয়াছেন, তাঁহারা ক্ষমতাবান ও স্নেহধন্য মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁহাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় নাই। থানার ভিতরে ফাইলকে ঢাল করিয়া টেবিলের তলায় আত্মরক্ষা করিতে পুলিশের তত্‌পরতা ও অতঃপর এই বিচিত্র ‘তদন্ত’ ও ধরপাকড়ের কাহিনির জন্য পুলিশমন্ত্রী স্বর্ণপদক দাবি করিতে পারেন।

এত কাল রাজ্যের জেলায় জেলায় ‘আমরা’র পালন এবং ‘ওরা’র দমন চলিয়া আসিতেছে। দলীয় দুর্বৃত্তদের যথেচ্ছাচার জনসাধারণকে অতিষ্ঠ করিতেছে। খুনি হউক বা ধর্ষক, অভিযুক্ত শাসক দলের হইলে পুলিশ তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগই লইবে না, প্রশাসনের উচ্চ স্তর হইতে ফাঁড়ি অবধি দুষ্কৃতীদের না-ধরার, বরং অভিযোগকারীদেরই ভুয়া মামলায় জড়াইয়া হেনস্থাকরার, কখনও সালিশি সভার আয়োজন করিয়া মিটমাট করিয়া লওয়ার নিদান আসিতেছে। বিরোধী দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে শাসক দলের মাস্কেট বাহিনীর অভিযান পুলিশি প্রহরা ও ১৪৪ ধারার মধ্যেই সংঘটিত হইতেছে। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের নামে বিরোধী-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে হানা দিয়া ধরপাকড় ও নির্যাতনও শুরু হইয়াছে, শাসক দলের সমর্থকদের ঘাঁটিগুলিকে নিশ্চিন্তে আগ্নেয়াস্ত্র মজুত করার সুযোগ দিয়া। আবার জেহাদি সন্ত্রাসবাদীদের মৌলবাদ ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ঘাঁটিগুলিও পুলিশের উদাসীন প্রশ্রয়েই রাজ্যের নানা জেলায় শিকড় বিস্তার করিয়াছে। সমগ্র পরিস্থিতি শীর্ষ শাসক রাজনীতিকদের গোচরেই হইতেছে। আইনের শাসন বলিয়া কিছু আর অবশিষ্ট নাই। কারণ যাঁহারা আইনরক্ষক, শাসকাশ্রিত দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত এমনকী নিহত হইলেও তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের স্বাধীনতা তাঁহাদের নাই। সুশাসনের শর্ত পদে পদে লঙ্ঘিত হইতেছে। আদালতের ক্রমাগত তিরস্কার জানাইয়া দেয়, পশ্চিমবঙ্গ কার্যত গোল্লায় গিয়াছে।

আলিপুরের মতো রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে ভয়াবহ কুনাট্য বলিয়া দিতেছে, এখানে অন্যায়ের প্রতিবিধানের কোনও সম্ভাবনা নাই। নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক আধিপত্য সত্ত্বেও একটি শাসক দল যে এ ভাবে স্বেচ্ছাচারী হইতে পারে, ভাবা কঠিন। ইহাকে বর্গির রাজত্ব বলিলে ভুল হয়। মরাঠা বর্গিরা সুদূর ভিনরাজ্য হইতে লুণ্ঠনের জন্য আসিয়া বাংলায় যে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল, স্বভূমিতেই দুর্বৃত্তদের রাজনীতিতে অভিষিক্ত করিয়া তৃণমূল কংগ্রেস সেই অনাচার ও মাত্‌স্যন্যায়, সেই ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলিয়াছে। হার্মাদরা এখন আর নেতাদের আজ্ঞাবহ যন্ত্র নয়, এখন হার্মাদরাই যন্ত্রীর ভূমিকায়। তাই দুর্বৃত্তরা পশ্চিমবঙ্গে আর পুলিশকে ভয় পায় না, বরং উচ্চাসনের বরাভয়পুষ্ট দুষ্কৃতীদেরই পুলিশ ভয় করিয়া, সমীহ করিয়া চলে। সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষের অবস্থা অনুমেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE