একটি মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, দম্পতির মধ্যে এক জন যদি পরকীয়া সম্পর্কে জড়াইয়া পড়েন, সেই ঘটনাকে অন্য জনের আত্মহত্যার প্রণোদনা বলিয়া ধরা যাইবে না। রায়টি সরল নহে। মামলার ঘটনায়, এক স্ত্রী নিজ স্বামীকে অন্য নারীর সহিত ঘনিষ্ঠ অবস্থানে দেখিয়াছিলেন ও দুই দিন পরে কূপে ঝাঁপ দিয়া আত্মহত্যা করেন। সাধারণ বোধ বলে, এই মৃত্যুর জন্য স্বামীই দায়ী হইলেন। কারণ, তিনি বিবাহের আনুগত্যের শর্তটি লঙ্ঘন করিয়াছেন। বিবাহে যদি এক জন তাঁহার দোসরের পরকীয়া সম্পর্কের কথা নিশ্চিত ভাবে জানিতে পারেন, তবে বিবাহ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াইয়া আছে যে পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর— তাহা নড়িয়া যাইতেই পারে। সেই বিশ্বাসভঙ্গের ও তাহার ফলস্বরূপ হৃদয়বেদনার, দায় কাহার? কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, কথা হইতেছে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ লইয়া নহে, আত্মহত্যার প্ররোচনা বিষয়ে। কেহ নিজের বিবাহবন্ধনকে যতই প্রিয় মনে করুন, বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হইয়া নিজেকে যতই বঞ্চিত ও আহত মনে করুন, তিনি নিজ জীবন শেষ করিয়া দিলে, অন্য পক্ষকে সরাসরি দায়ী করা চলিবে কি? এইখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রণোদনার কথা আসিয়া পড়ে।
আত্মহত্যার প্ররোচনার অর্থ: এমন পরিস্থিতি সচেতন ভাবে প্রস্তুত করা, যাহা পীড়িত মানুষটির সম্মুখে আত্মহত্যা ব্যতীত অন্য কোনও উপায়ই অবশিষ্ট রাখে না। যে লোকটি পরকীয়া করিতেছে, সে নিজ আনন্দের জন্য একটি কাজ করিতেছে যা তাহার বিবাহসঙ্গীকে সম্ভবত আঘাত করিবে বলিয়া সে অনুমান করিতেছে। কিন্তু তাহার অর্থ ইহা নহে, সে আঘাত করিবার জন্যই কাজটি করিতেছে। সে বিবাহের চুক্তি রক্ষা করিবার জন্য নিজের লোভকে সংযত করে নাই, তাহা লইয়া সমাজ তাহাকে তিরস্কার করিতে পারে, কিন্তু সে যে নিষ্ঠুর ভাবে তাহার সঙ্গীর মৃত্যু চাহিতেছিল এবং সেই উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ চেষ্টা করিতেছিল, বলা যাইবে না। ইহাও মানিতে হইবে, কেহ স্ত্রীকে ভালবাসিতে পারে, এবং একই সঙ্গে পরকীয়ায় জড়াইয়া পড়িতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর মৃত্যুকামনা তো দূর, সে স্ত্রীর বেদনায় বেদনার্তও হইবে, আবার পরকীয়াটিকে টিকাইয়া রাখিতে চাহিবে। মানুষ তো পরস্পরবিরোধী আকাঙ্ক্ষা যুগপৎ লালন করিতেই পারে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নও উঠিবে। এক জন বিবাহকালে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হইবে না, কিন্তু তাহা বলিয়া বাস্তবে সে বিবাহ-দোসর ব্যতীত কাহারও সহিত কোনও দিন প্রণয়সম্পর্ক স্থাপন করিতে পারিবেই না, ইহা মানিয়া লইলে আইনে বিবাহবিচ্ছেদের পরিসরটিই থাকিত না। বিবাহ ও যাবজ্জীবন দণ্ডভোগ এক নহে, মানুষের হৃদয় ও তাহার কামনা পরিবর্তিত হইতেই পারে। ‘বিশ্বাস’ও পরিস্থিতিসাপেক্ষে বদলাইয়া যায়। এক স্ত্রী তাঁহার স্বামীকে অবিশ্বস্ত ভাবিয়া আঘাত পাইলে, তাঁহার উচিত বিচ্ছেদ চাহিয়া মামলা করা। পরিবর্তে তিনি যদি কূপে ঝাঁপ দেন, তাহা প্রবল দুঃখজনক, এবং তাঁহার প্রিয়জনের নিকট স্বামীটি পাপী প্ররোচক হিসাবেই প্রতিভাত, কিন্তু আদালত চলিবে যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া, আবেগ বা নাটকীয়তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়া নহে। তাহাকে স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামীটির কথাও সমান গুরুত্ব দিয়া বিবেচনা করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy