Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আমরা এগোচ্ছি, কিন্তু অন্যরা বেশি এগোচ্ছে

সর্বজনীন শিক্ষার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। এ রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিও বরং গত কয়েক বছরে অনেক দ্রুত উন্নতি করছে। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষার মূল্য কবে বুঝবে? সর্বজনীন শিক্ষার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। এ রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিও বরং গত কয়েক বছরে অনেক দ্রুত উন্নতি করছে। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষার মূল্য কবে বুঝবে?

মানবেশ সরকার।
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৪ ০০:২৪
Share: Save:

অশিক্ষা যে কত গুরুতর হতে পারে, তার প্রমাণ তো পশ্চিমবঙ্গে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। তবুও ছোট ছোট বাচ্চারা সত্যিকারের কী শিক্ষা অর্জন করছে, সে বিষয়ে রাজ্য কি যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারছে? বিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নিউপা) এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট এই ভাবনাকে জোরদার করেছে।

ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ডাইস)-এর মাধ্যমে রাজ্যের প্রত্যেকটি বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদ্যালয় শিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ সাংঘাতিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নীচে রয়েছে ঝাড়খন্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ। ২০১০ সালে শিক্ষার অধিকার আইন চালু হওয়ার আগে, ২০০৯-১০-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে ঝাড়খন্ড ও বিহার ছাড়া যে সব রাজ্য ছিল, তারা এখন পশ্চিমবঙ্গের উপরে চলে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ অবশ্য ২০০৯-১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের উপরে থাকলেও বর্তমানে একেবারে সর্বনিম্ন স্থানে চলে এসেছে।

এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়ার এই গাণিতিক হিসেব সব সময় বাস্তব অবস্থাকে সম্যক বুঝতে সাহায্য করে এমনটা নয়। যেমন, ২০০৯-১০-এ পশ্চিমবঙ্গের নীচে, ২৮তম স্থানে অবস্থানকারী ওড়িশা, বর্তমানে অনেক উপরে, ২১তম স্থানে উঠে আসলেও, পশ্চিমবঙ্গের পাশের এই রাজ্যে এখনও এক শিক্ষকবিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে ৪ শতাংশ, আর ওড়িশায় ৯ শতাংশ। শিক্ষায় অগ্রগতি বিশ্লেষণের জন্য ‘নিউপা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’-এর সূচক খুব ত্রুটিমুক্ত নয়। যেমন, বিদ্যালয়ে শিশুদের হাজিরা, শিশুদের অর্জিত শিক্ষার মানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি এই সূচকে ধরা হয় না। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় অসমের শিশুদের অর্জিত শিক্ষার মান পশ্চিমবঙ্গের শিশুদের তুলনায় অনেক খারাপ দেখা গেলেও, ‘নিউপা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’-এর সূচকে অসম বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উপরে অবস্থান করছে। তাই এই সূচক দিয়ে রাজ্যের অবস্থা খুব ভাল ভাবে বোঝা যায় না। তবে এটা বোঝা যায় যে, শিক্ষায় রাজ্যগুলোর এগিয়ে চলার গতিতে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়েছে।

নব্বইয়ের দশকের আগে পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির অগ্রগতি মূলত রাজ্য সরকারের নিজস্ব উদ্যোগের উপরই নির্ভরশীল ছিল। রাজ্যের শিক্ষার অগ্রগতিতে কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন অনেক বেড়ে যাওয়ায়, বিদ্যালয় শিক্ষায় রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারকেও উদ্যোগী হতে হয়েছে। অন্য দিকে, শিশুর শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। বলে রাজ্য সরকারগুলির উপর সর্বজনীন শিক্ষার চাপও বেড়ে গেছে। তাই মৌলিক শিক্ষার প্রসারের জন্য এই শতকের শুরুতে কেন্দ্রীয় সহযোগিতায় দেশব্যাপী সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু হলে, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বহু রাজ্যই শিক্ষায় উন্নতি ঘটানোর জন্য উদ্যোগী হয়েছে। যে সমস্ত রাজ্য গত শতকের শেষেও শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল, তারাও দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, বিহারের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা রাজ্যেও ২০০৯-১০ সালে ৫-১৪ বছর বয়সের শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুই বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত। ২০০৪-০৫-এ এই হার ছিল শতকরা ৬৫ ভাগ। অর্থাত্‌, ৫ বছরের মধ্যে বিহারে ১০ শতাংশ বিন্দু উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ওই একই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির মাত্রা ৫ শতাংশ বিন্দু (শতকরা ৮৩ ভাগ থেকে শতকরা ৮৮ ভাগ)। এখন বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পার্থক্যও অনেক কমে গেছে। এই উন্নতির মাত্রায় কোনও কোনও পিছিয়ে থাকা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। সঙ্গের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ‘নিউপা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’-এর রিপোর্টে ২০০৮-০৯-এ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অসমে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়-ছুট শিশুর অনুপাত বেশি হলেও গত চার বছরে তা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কমে গেছে। সারণিতে ‘নিউপা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’-এর সূচকে অন্তর্গত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নিরিখে এই ওঠানামার বিষয়টি দেখা যেতে পারে। এই সারণিতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সেই বড় বড় রাজ্যগুলিকে নেওয়া হয়েছে, যারা ২০০৯-১০-এ পশ্চিমবঙ্গের নীচে ছিল, কিন্তু ২০১৩-১৪-তে পশ্চিমবঙ্গের উপরে অবস্থান করছে। এবং ২০০৯-১০-এ নিজস্ব অবস্থান সাপেক্ষেও উপরে অবস্থান করছে।

সারণিতে দেখা যাচ্ছ যে, উন্নতি করলেও প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুপাতের বিষয়টি ছাড়া বাকি দু’টি বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির মাত্রা অন্যদের থেকে কম।

এক শিক্ষক বিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান অন্যদের থেকে ভাল হওয়া সত্ত্বেও অন্যরা যে-মাত্রায় উন্নতি করে চলেছে, তাতে এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না তা দেখার অপেক্ষা রাখে। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুপাত কোন অবস্থানে পৌঁছবে, সেটাও দেখার। অল্পসংখ্যক উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলও পশ্চিমবঙ্গের একটি পুরনো সমস্যা। এখানে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে হাই স্কুল খুব কমই গড়ে উঠেছে। মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে ওঠা স্কুলের আর্থিক দায়িত্ব নেওয়াই ছিল এখানকার সরকারি রেওয়াজ। ফলে প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুপাতের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে, নিজের অবস্থার সাপেক্ষে পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও উন্নতি করেছে, তবে তা অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ধীর গতিতে। আসলে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার প্রসারে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবের এক ঐতিহ্য রয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতা আধুনিক শিক্ষার অন্যতম একটি কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও এ রাজ্যের শাসকরা মৌলিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে এমন কোনও ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়নি, যা পশ্চিমবঙ্গকে শিক্ষার ক্ষেত্রে শীর্ষে পৌঁছে দেবে। বামফ্রন্ট শাসনের শুরুর দিকে এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ লক্ষ করা গিয়েছিল। পরবর্তী কালে সেই প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে যায়। ইচ্ছাশক্তির অভাবের এই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন, শিক্ষা অধিকার আইনকে কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম (রুল) বানাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অযথা দেরি। এই আইন ২০১০ সালে চালু হলেও এই আইনের নিয়ম বানাতে সরকারের দু’বছর লেগে যায়। অথচ ওড়িশা বা ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলি এই নিয়ম এক বছরের মধ্যেই বানিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিল।

তাই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যে বাস্তব চিত্র ধরা পড়ছে, তার থেকে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবকে দূর করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho manabesh sarkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE