উনিশশো বিরানব্বই সালের ছয় ডিসেম্বর। দিকদিগন্ত হইতে করসেবক মিছিল উত্তাল হুঙ্কার দিতে দিতে যখন বাবরি মসজিদ ভাঙিল, সে দিনের সেই ঐতিহাসিক ও অবিমৃশ্যকারী উন্মাদনা শাস্তিযোগ্য ছিল কি না, তাহা এই মুহূর্তেও, পঁচিশ বৎসর পরও, অমীমাংসিত রহিয়া গিয়াছে। লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং উমা ভারতী, মুরলীমনোহর জোশীর মতো অন্যান্য বিজেপি নেতারা কিংবা করসেবকরা কোনও রকম অন্যায় কিংবা অনৈতিক কাজ করিয়াছিলেন কি না, তাহা এখনও, পঁচিশ বৎসর পরও, অপ্রমাণিত রহিয়া গিয়াছে। সপ্তদশ শতকে নির্মিত একটি মসজিদ বিংশ শতকের শেষ দশকে আসিয়া সযত্নপ্রস্তুত জনরোষ-বিস্ফোরণে যে ভাবে খণ্ডবিখণ্ড হইয়া পড়িল, তাহা ভারত সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি করে, পঁচিশ বৎসর পরও তাহা অসংশোধিত রহিয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যে বহিঃপৃথিবীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিবার অস্বাভাবিক ছবিটি এ দেশের অন্যতম পরিচয় হিসাবে বিপুল ভাবে স্বীকৃত এবং নিন্দিত। কিন্তু, পঁচিশ বৎসর পরও, পুরা ঘটনাটি বিচারসিদ্ধ অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবার অবকাশ পায় নাই। ইহার মধ্যে ভারতীয় গণতন্ত্র বিষয়ে নিশ্চয়ই একটি বার্তা আছে। সেই বার্তা সুখকর নহে।
ধ্বস্ত বাবরি মসজিদ এখনও বিচারের নিভৃত অপেক্ষায়। তবে রামমন্দির নির্মাণ লইয়া ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি একটি মত প্রকাশ করিলেন। সে মত পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সংকট মিটাইবার পক্ষে। যদি একান্তই তাহা সম্ভব না হয়, সংকট যদি না মেটে, সে ক্ষেত্রে আদালত মধ্যস্থতাও করিতে পারে। সুপ্রস্তাব, অন্তত আপাতবিচারে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একসঙ্গে পরস্পরের সহিত বসিয়া আদানপ্রদানের ভিত্তিতে সংকট মিটাইয়া ফেলিলে তাহা বৃহত্তর সমাজের পক্ষে নিশ্চিত ভাবে মঙ্গলজনক। কিছু পক্ষ ইতিমধ্যেই এই রায়কে স্বাগত জানাইয়াছে, কতকগুলি মুসলিম সংগঠন হইতে আগেই এই প্রস্তাব আসিয়াছিল। মধ্যস্থতার প্রস্তাবেও তাঁহারা আশ্বস্ত বোধ করিতেছেন। মন্দির নির্মাণপন্থীদের মধ্যে অবশ্য দুই-একটি সংগঠন ব্যতীত এই প্রস্তাবে কাহারও উৎসাহ দেখা যায় নাই। স্বাভাবিক। বিজেপি-প্লাবিত উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বে রামমন্দিরের মতো বিষয় মিটাইতে যদি এখন ‘আলোচনা’য় বসিতে হয়, হিন্দু সংগঠনগুলির কাছে তাহা উৎসাহব্যঞ্জক হইবার কথা নয়।
প্রশ্ন এখানেই। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটাইতে হইলে আলোচনার যোগ্য পরিবেশ থাকা চাই। পঁচিশ বৎসর বিষয়টি ঝুলিয়া থাকিবার পর এখনও কি পরিবেশের সেই আলোচনাযোগ্যতা অযোধ্যায় বিরাজ করিতেছে? যাঁহারা সে দিন প্রকাশ্য দিবালোকে বর্বর অভিযানকে প্রত্যক্ষ উসকানি দিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই যদি এত দিনে কিছু না বলা যায়, তাহা হইলে পরিবেশ বিষয়ে কি দ্বিতীয় বার ভাবিবার অবকাশ আছে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিষয়টি মিটাইয়া লইতে বিশেষ উৎসাহী। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় রাষ্ট্রে এই বিতর্কটি এক অতি বৃহৎ ধর্মীয় সংকট, ধর্মীয় বিভাজিকা। এই বিতর্ক মিটাইতে পারিলে তাঁহার রাজনৈতিক জীবনের কৃতিত্বপঞ্জিটি বহু গুণ উজ্জ্বল দেখাইবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই তাড়া বা তাড়নাও কি মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে ‘আলোচনার পরিবেশ’ বিষায়িত করিবে না? বস্তুত, যথার্থ আলোচনার পথে মীমাংসার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল সমস্তরে থাকিবে, ইহা একটি আবশ্যিক শর্ত। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এই প্রবল দাপটের কালে সেই সমতা কোথায়? আশাবাদী আশা করিতেই পারেন, প্রধান বিচারপতির প্রসারিত আলোকবর্তিকা নূতন পথ দেখাইবে। তবে কিনা, মোদী-যোগীর ভারতে অন্ধকার ও আলোকের সংঘাতটিতে হারজিতের অনিশ্চয়তা বড় বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy