তার পর? উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে। নভেম্বর ২০১৪। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ হতে গেলে কী লাগে? হয়তো কেন্দ্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, হয়তো তাতে বহু লক্ষ বা কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়িত হচ্ছে, সে জন্য নিত্য আদানপ্রদান করতে হচ্ছে এক দিকে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গ, অন্য দিকে সরকারি-বেসরকারি নানা অর্থসংস্থার সঙ্গে। কেন্দ্রটি যদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, আজ তার অধিকর্তার দরকার শুধু কনিষ্ঠতম শিক্ষকপদের ন্যূনতম যোগ্যতা, আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘কৌতূহল’ (ইন্টারেস্ট)। দরকার নেই প্রাসঙ্গিক ডিগ্রির, দরকার নেই প্রকাশিত বই বা গবেষণাপত্র বা প্রকল্প সাধনের অভিজ্ঞতার। এ সব না থাকলেও উপাচার্য তাঁর একক সিদ্ধান্তে যে-কোনও শিক্ষককে ওই পদে নিয়োগ করতে পারেন, চাইলে বহাল রাখতে পারেন সেই ব্যক্তির পূর্ণ কর্মজীবন, আবার বিরাগ জন্মালে বিদায়ও করতে পারেন রাতারাতি।
এই চমকপ্রদ নিয়মটি তিন মাস যাবৎ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে। বর্তমান সরকার তিন বছরে তিন বার আইন বদলে উপাচার্যদের হাতে অসীম ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করেছে যে, কাউন্সিল, কোর্ট প্রভৃতি সভায় শিক্ষক প্রতিনিধিদের আসন গত তিন বছর (এবং অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে) শূন্য থাকবে, ঠাঁই পাবেন একমাত্র মনোনীত ও পদাধিকার-ভিত্তিক সদস্যেরা। অতএব প্রতিরোধ দূরে থাক, আলোচনার পাট কার্যত উধাও। এমন অনুকূল পরিস্থিতিতে উপরোক্ত নিয়মাবলি কর্মসমিতির অনুমোদন পেয়েছে সেই স্মরণীয় ১৬ সেপ্টেম্বর, যে দিন রাতে ছাত্রদের উপর পুলিশি হামলা হয়। এমন একুশে আইনও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্থ অস্তিত্বের উপর বড় কম আঘাত নয়: সারস্বত মান ও প্রশাসনিক শুভবুদ্ধির যে অবনমন সম্প্রতি একটানা ঘটে চলেছে, তার এক বিশেষ উৎকট নিদর্শন।
এত করেও সাত-আটটি গবেষণাকেন্দ্র চার মাস অধ্যক্ষহীন। দু’একটির অধ্যক্ষ এতই নবাগত যে তাঁরা এখনও ‘প্রোবেশন’-এর গণ্ডি পেরোননি। অগস্ট মাসে কোনও আগাম আলোচনা ছাড়া সব ক’টি কেন্দ্রের পূর্ববর্তী অধ্যক্ষকে পদ থেকে খারিজ করা হয়। বর্তমান বিধি অনুসারে উপাচার্য যেহেতু যা-খুশি করতে পারেন, আগের অভিজ্ঞ ও সফল অধ্যক্ষদের (বা অন্য কোনও উপযুক্ত শিক্ষককে) ফিরিয়ে আনতে বাধা নেই, কিন্তু তেমনটা অবশ্যই ভাবা হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট কৌশল, সামরিক ক্ষেত্রে যাকে বলে ‘স্কর্চড আর্থ পলিসি’, পশ্চাদ্গমনের সময় একটা জায়গা ছারখার করে সেখানকার সব সম্পদ নিশ্চিহ্ন করা।
দশ-পনেরো-কুড়ি বছরের শ্রমের ফসল, বহু কষ্টে গড়ে-তোলা ব্যাপক সারস্বত যোগাযোগ, হেলায় নিশ্চিহ্ন করা বড় সহজ। ক্ষতিটা এখনও পুরো ধরা পড়ছে না, কারণ পূর্বার্জিত প্রকল্পগুলি এখনও চালু আছে (যেমন, এই জুলাই মাসের ‘ন্যাক’ রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব উচ্চ মূল্যায়ন হয়েছে ২০০৮ থেকে ২০১০-এর কাজের ভিত্তিতে)। কিন্তু নতুন প্রকল্প আসা বন্ধ, তার বন্দোবস্ত করার লোক নেই। অভাবটা বোঝা যাবে আগামী বছর থেকে, ২০১৬-১৭’য় চরম আকার ধারণ করবে।
গবেষণাকেন্দ্রের গণ্ডি পেরিয়ে, বৃহত্তম প্রেক্ষিতে পরিস্থিতিটা দেখা যাক। কেন্দ্রগুলির কথা বড় করে বললাম, কারণ সেখানেই সার্বিক সংকটের সবচেয়ে তীব্র ও ধ্বংসাত্মক প্রতিফলন। পঠনপাঠনের সাবেক বিভাগগুলি আরও পোক্ত নিয়মাবলির ভিতে দাঁড়িয়ে, সেগুলি তছনছ করা কিঞ্চিৎ কঠিন। সেখানেও প্রচুর গবেষণা হয় এবং যে-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সার্বিক মান নির্ভর করে বিভাগের ভিতরে ও বাইরে এই গবেষণার বাতাবরণের উপর। পঠিত বিষয়ের নতুন-নতুন উন্মেষ ও তার আন্তর্বিষয়ক যোগ নিয়ে শিক্ষকরা যত বেশি চর্চা করবেন, তার ফলপ্রসূ প্রভাব ছড়াবে প্রাক্-স্নাতক শিক্ষাদান পর্যন্ত, এমনকী সেই স্তরের ছাত্রেরাও সক্রিয় ভাবে তাতে অংশ নেবে।
প্রবল আক্ষেপ ও চিন্তার বিষয়, বিভাগগুলির মধ্যেও এই গবেষণাসমৃদ্ধ পঠনপাঠনে বিঘ্ন দেখা দিচ্ছে। কৃতী অধ্যাপকরা বাধা ও অসম্মানের সম্মুখীন হচ্ছেন, দৈনন্দিন কাজে নানা নতুন উপদ্রবের কথা বড় বেশি শোনা যাচ্ছে। শিক্ষককুলের যে উৎসাহ-উদ্যম যাদবপুরের সবচেয়ে বড় সম্বল ছিল, তাতে স্বভাবতই ভাটা পড়ছে। তার বদলে দেখা দিচ্ছে গভীর উদ্বেগজনক এক ধারা, যা এক বছর আগেও চিন্তার অতীত ছিল: এক ধরনের ভীতি ও আড়ষ্টতা।
বাম আমলের দলতন্ত্রের কথা নতুন করে বলার দরকার নেই। কিন্তু যে কারণেই হোক, যাদবপুরে তার প্রকোপ ছিল কম। অনেক অধ্যাপক অন্যত্র অতিষ্ঠ বা উৎপীড়িত হয়ে সেখানে এসে মুক্ত পরিবেশে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পেরেছেন, চিন্তা করতে পেরেছেন। বিপরীতটাও অবশ্যই ঘটেছে, কিন্তু তুলনায় কম। নইলে ওই সময়ে যাদবপুর এত উৎকর্ষ লাভ করতে পারত না।
আজ কিন্তু সেখানেই শুনতে হচ্ছে, সত্য বা কাল্পনিক রাজনৈতিক যোগের কারণে অমুক যোগ্য শিক্ষককে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না, অমুক সুপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপকের যোগ থাকলে প্রস্তাব মঞ্জুরের আশা নেই। সবিশেষ দৃষ্টান্ত দেব না: তাতে নতুন বিঘ্ন দেখা দিতে পারে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা অস্বস্তিতে, এমনকী বিপদে পড়তে পারেন। কিছু বিবরণ অতিরঞ্জিত বা নিছক রটনা হতেই পারে, সবগুলি নয় তা নিশ্চিত জানি। কিন্তু আসল প্রশ্ন, যাদবপুরের মুক্ত পরিবেশ এমন ক্লেদাক্ত হয়ে উঠল কী করে?
যাদবপুরের শ্রীবৃদ্ধির পিছনে যে শিক্ষককুলের এত দিন সোৎসাহ অবদান, মতিভ্রম ঘটায় আজ তাঁরাই অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছেন, এটা এক কথায় মেনে নেওয়া দুষ্কর। রাজনৈতিক বিরোধিতার যুক্তিও সহজে টেকে না। পাঁচ-ছ’শো শিক্ষক সকলেই এক রাজনৈতিক শিবিরের, এমনটা ভাবাই অবাস্তব। তা ছাড়া, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে সাড়ে তিন বছর হল, বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ক্ষোভ ও হতাশ দানা বেঁধেছে মাত্র চার-পাঁচ মাস। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই ১৬ ডিসেম্বরের পুলিশি তাণ্ডব। আজ পর্যন্ত তার কোনও স্থায়ী প্রশমন বা নিষ্পত্তি সাধনের ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লোজার’— বিন্দুমাত্র চেষ্টা হয়নি। আর একটা কারণ, বিশেষত শিক্ষককুলের কাছে, এই ক’মাসে প্রায় অবিশ্বাস্য গতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সারস্বত কাঠামো ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টা।
এই অভিযানের কোনও পর্যায়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। শিক্ষকদের তরফে কিন্তু কেবল দাবি বা প্রতিবাদ নয়, লেখাপড়া-গবেষণা নিয়ে একাধিক আবেদন, প্রস্তাব ও আলোচনার অনুরোধ পেশ হয়েছে। তাতে কর্ণপাত করা হয়নি, বরং চপেটাঘাতের মতোই প্রায়ই পত্রপাঠ তাঁদের বক্তব্যের বিরোধী কোনও নির্দেশ বা ঘোষণা করা হয়েছে, নিয়ম পাল্টানো হয়েছে পর্যন্ত। ‘আলোচনার রাস্তা সব সময় খোলা’, এই উদার ঘোষণায় শিক্ষক-ছাত্র কেউই আর তাই কান দিচ্ছেন না।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দোষ-ত্রুটি ছিল ও আছে। কিন্তু তার সাম্প্রতিক সমস্যা প্রায় সর্বাংশে প্রাঙ্গণের ভিতরের ও বাইরের কর্তৃপক্ষের স্বসৃষ্ট। তার মূল চরিত্র শাসনগত নয়, সারস্বত, ডিসিপ্লিনারি নয়, অ্যাকাডেমিক। এই সত্যটা কর্তৃপক্ষ স্বভাবতই স্বীকার করছেন না, বরং ছাত্রদের উপর দায় চাপিয়ে, শাসন-দমনের তাগিদটা বড় করে তুলে ধরে, সারস্বত কাঠামোর উপর নেপথ্য আক্রমণ থেকে সাধারণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। ছাত্রেরাও হয়তো সম্যক বুঝছে না, তাদের খোলা মনের আন্দোলন হয়ে পড়ছে বয়স্কদের খেলার ঘুঁটি।
সমাবর্তন নিয়ে আলোড়নে এই ধারাটিই প্রকাশ পাচ্ছে। সমাবর্তন তো হবে আনন্দ ও সাফল্যের উৎসব: উভয় খাতেই যথেষ্ট রসদ যাদবপুরের মানবভাণ্ডারে মজুত আছে। অথচ নিতান্ত বাহ্যিক ও ব্যক্তি-ভিত্তিক কারণে সেই অনুষ্ঠান এখন হয়ে উঠছে বিশেষ উৎকণ্ঠা এবং নজরদারির উপলক্ষ।
এই অবস্থা বজায় থাকলে কালক্রমে যাদবপুরকে ধ্বংস করতে আর কিছু দরকার নেই। ক্লান্তি ও হতাশাজনিত— হয়তো বা দমনবশত— আপাত-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে, সেই প্রতিরোধশূন্য পরিবেশে শিক্ষানিধন পর্ব আরও নির্বিঘ্নে সাধিত হতে থাকবে।
আমি বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমার আর কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু যাদবপুর প্রাঙ্গণ ভরে আছে উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীর দল, সেই লোভে এখনও সেখানে কিছু শিখতে যাই, কাজে হাত লাগাতে যাই। সেই শিক্ষালাভের পথে বাধা ঘটায় আমিই বিচলিত ও ক্ষতিগ্রস্ত বোধ করছি। যারা খাতাকলমে শিক্ষার্থী, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করে জীবন আরম্ভ করতে চলেছে, তাদের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ পণ্ড করার অপরাধ তবে কোন মাত্রার? জ্ঞানের যথার্থ সমাবর্তনে যারা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও মাননীয় আচার্য কড়া পদক্ষেপ নেবেন তো?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy