সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর অনুপস্থিতি ‘সাজানো ঘটনা’ কি না, প্রশ্ন উঠিয়াছে। হয়তো কালীঘাট হইতে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের নিকট নির্দেশ পৌঁছাইয়াছিল। অথবা, হয়তো পৌঁছায় নাই। তিনি স্বেচ্ছায় পরাজিত হইয়াছেন। তিনি পদপ্রাপ্তির ঋণ পরিশোধ করিতেছেন। বঙ্গেশ্বরী তাঁহার নিকট ঠিক কী প্রত্যাশা করেন, সুশান্তরঞ্জনের অজানা নহে নিশ্চয়। মীরা পাণ্ডের কাহিনি তিনি বিলক্ষণ জানেন। অনুমান করা চলে, সুশান্তরঞ্জন বুঝিয়া লইয়াছেন, কমিশনের দফতরে কালীঘাটের প্রতিনিধিত্ব করাই তঁাহার কর্তব্য। তিনি সেই কর্তব্য সম্পাদন করিতেছেন। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারকে ফাঁকা মাঠে গোল করিবার সুযোগ করিয়া দেওয়াই তাঁহার একমাত্র কৃতিত্ব নহে। ইতিপূর্বে তিনি পরীক্ষার মধ্যেই কলিকাতা পুরসভার দিন ঘোষণা করিয়াছেন, পরীক্ষা চলাকালীন মাইক বাজাইয়া প্রচারের অনুমতি দিয়াছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হইতে অস্বীকার করিয়াছেন, ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যথাযথ ব্যবহার করেন নাই, ভোটের দিন বিপুল সন্ত্রাস দেখিয়াও মুখ বুজিয়া থাকিয়াছেন। নেত্রীর প্রতি তাঁহার বিশ্বস্ততায় খুঁত নাই। তাহাতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির সম্মান ধুলায় মিশিলে মিশিয়াছে। কেহ বলিতেই পারেন, সুশান্তরঞ্জন তো সংবিধানের বদান্যতায় পদটি পান নাই। কাহার ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে, সেই হিসাবে তাঁহার ভুল হয় নাই।
‘নিজের লোক’ বসাইবার ইহাই সুবিধা। তাঁহারা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের সুরে গাহিতে পারেন, ‘তোমার মনের কথা আমি জানি’। এবং, সেই কথাটি যাহাতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়, তাহা নিশ্চিত করেন। মীরা পাণ্ডের সহিত সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের ফারাক এইখানেই। দুই বৎসর পূর্বে সুপ্রিম কোর্টেই রাজ্য সরকারের সবিশেষ বিড়ম্বনার কারণ হইয়াছিলেন মীরা। কালীঘাটের নিকট মাথা নোওয়াইবার দায় তাঁহার ছিল না। দুর্জনে বলিবে, সুশান্তরঞ্জনের বিলক্ষণ আছে। মুখ্যমন্ত্রীর এমন লোকই পছন্দ, যাঁহারা তাঁহার মনের কথা বুঝিয়া কাজ করিয়া ফেলিবে। এমন উপাচার্য, যিনি বন্ধের দিন পরীক্ষা চালাইতেও দ্বিধা করিবেন না। এমন পুলিশ সুপার, যিনি আদালতের আদেশ অমান্য করিয়াও আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে বাগড়া দিবেন। এমন ‘নিজের লোক’ দিয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলি ভরিয়া ফেলিতে পারিলেই আর চিন্তা থাকে না। তখন গণতন্ত্রের উপর যথেচ্ছাচার করা চলে, প্রশাসনকে পঙ্গু বানাইয়া ফেলা যায়। কালীঘাটের ইচ্ছাময়ীর এই সর্বগ্রাসের খেলায় সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ বো়ড়ে। তাঁহার গুরুত্ব দক্ষতায় নহে, পেশাদারিত্বে নহে, গুরুত্ব তাঁহার বিনা প্রশ্নে আত্মসমর্পণ করিবার ক্ষমতায়। তিনি গাহিতেই পারেন, ‘তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে’। মুখ্যমন্ত্রী দ্বিগুণ সন্তুষ্ট হইবেন।
ব্যক্তি সুশান্তরঞ্জনদের বিলক্ষণ অধিকার আছে মুখ্যমন্ত্রীর পদতলে নিজেকে সঁপিয়া দেওয়ার। কিন্তু, তিনি যখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রধান, তখন আর তিনি ব্যক্তিমাত্র নহেন। তাঁহার পদটিই তখন তাঁহার পরিচয়। পদটি তাঁহার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে। যে ভাবে তিনি রাজ্য সরকারের অন্যায় দাবির নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া চলিয়াছেন, তাহাতে পদটির আর সম্মান থাকে না। তিনি ফের নিজের অসহায়ত্বের দোহাই পাড়িতে পারেন। বড় মাপের জুতায় পা গলাইলে হোঁচট খাওয়া বিচিত্র নহে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সহ্য করিবার ক্ষমতা তাঁহার না-ই থাকিতে পারে। মেরুদণ্ডের জোর সবার সমান নহে। কিন্তু, তাহাতে সেই চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করিবার অপরাধ মাফ হইয়া যায় না। তিনি যদি বোঝেন, স্বাধীন ভাবে দায়িত্ব পালন করা তাঁহার কর্ম নহে, তবে পদত্যাগ করুন। এখনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy