কপিল সিব্বল। পি চিদম্বরম। অরুণ জেটলি। রবিশঙ্কর প্রসাদ। দলমত-নির্বিশেষে ভারতের সংসদে যে বাক্স্বাধীনতার এত সব সৈনিক মজুত রহিয়াছেন, তামাম ভারত জানিত কি? তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট লালপতাকা উড়াইতেই এই কংগ্রেসি ও বিজেপি নেতারা সুড়সুড় করিয়া কোটর হইতে বাহির হইয়া জোরগলায় দাবি তুলিতেছেন, তাঁহারা আগেই জানিতেন, ইহার অপেক্ষা অন্যায় গণতন্ত্রবিরোধী আইন আর হইতেই পারে না। প্রসঙ্গত, ইউপিএ-১ আমলে এই আইন হইবার সময় চিদম্বরম ছিলেন মন্ত্রী, প্রসাদ ছিলেন আইন-প্রণয়ন কমিটির সদস্য, এবং কপিল সিব্বল ছিলেন প্রণয়ন-পরবর্তী কালে এই আইনের সর্বাধিক উত্সাহী প্রবক্তা। গোটা বিজেপি দলের মুখে এখন এক রা, তাঁহারা প্রথমাবধিই এই আইনের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু আইন তো কেবল সরকার পক্ষের কলমের এক খোঁচায় তৈরি হয় না: সংসদীয় বিতর্কের প্রয়োজন হয়, বিরোধীদের মতামত আহূত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে। কোথায় গেলেন সেই গরিষ্ঠাংশ? মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মতো বিস্ময়াহত জিজ্ঞাসা: ৬৬এ যদি অনৈতিক হয়, তবে ইঁহারা কী করিতেছিলেন? আর ইঁহারা যদি তখন সংসদীয় ভূমিকাই পালন করিতেছিলেন, তবে ‘অনৈতিক’ ৬৬এ আইন হইল কী করিয়া? বেগতিক দেখামাত্রই ‘আমি তো কলা খাইয়াছি’র দায়িত্বজ্ঞানহীনতা যদি ইঁহারা সংসদে বসিয়াই দেখাইতে পারেন, তবে ভারতীয় গণতন্ত্রের হালটি ঠিক কী প্রকার?
সজ্জা-আভরণ হিসাবে একটি সংসদ-ভবন রাখিলেই যদি গণতন্ত্র হয়, তবে গণতন্ত্র লইয়া আর চিন্তা ছিল কী! বাস্তবিক, বস্তুটি কিয়ত্ দুষ্প্রাপ্য। পার্লামেন্টে বসিয়া প্রতিটি কাজের মধ্যে সত্ আলোচনা ও বিবেচনার প্রক্রিয়াটি সচল রাখিবার কাজটি গণতন্ত্রের মৌলিকতম কাজ। কেবল জমি বিলের মতো আন্দোলনসুলভ বিষয় লইয়া তর্ক হইবে, কিন্তু বৃহত্তর মৌলিকতর নীতিগুলি শুনিতে তত আকর্ষণীয় নয় বলিয়া আলোচনার কষ্ট ছাড়াই কেষ্ট অর্থাত্ বিল পাশ হইবে, ইহাতে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়। বিপন্নও হয়। পার্লামেন্টের মাধ্যমে জনসাধারণকে নিষ্পেষণ করিবার অস্ত্র সরকার তথা রাষ্ট্রের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, ইহার দৃষ্টান্ত বিশ শতকে নেহাত কম নয়। জার্মানিতে ন্যাশনাল সোশ্যালিজম-এর জয়ও কিন্তু পার্লামেন্টীয় প্রথামাফিকই আসিয়াছিল। একের পর এক যুদ্ধসিদ্ধান্ত ও যুদ্ধকালীন গণ-অধিকার-হানির সিদ্ধান্তও বিভিন্ন গণতন্ত্র-শোভিত পার্লামেন্ট দ্বারাই আনীত হইয়াছিল বিভিন্ন পশ্চিমি দেশে।
সুতরাং গণতান্ত্রিক মুক্তির পক্ষে সংসদ জরুরি হইলেও যথেষ্ট নয়, হইতে পারে না। কেননা শেষ পর্যন্ত সংসদে যাঁহারা আসীন হন, তাঁহারা সামাজিক এলিট হউন বা না হউন, রাজনৈতিক এলিট বটেই। তাঁহাদের স্বার্থ ও যুক্তির একটি পরম্পরা থাকিবার কথা, যাহা সমাজের বৃহত্তর অংশের স্বার্থের অনুকূল না হওয়াই সম্ভব। এই ফাঁকের জায়গাটি ভরাট করিবার জন্যই বিরোধী পক্ষের ভূমিকার উপর ভারতীয় সংবিধানে এতখানি জোর দেওয়া হইয়াছিল, আশা ছিল, বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মত-সংঘাতের মধ্য দিয়া সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার অন্তত আংশিক নিরাময় সম্ভব। ঐতিহাসিক এরিক হবস্বম তাঁহার ‘এজ অব এক্সট্রিমস্’ বইতে লিখিয়াছিলেন, ধনতন্ত্র এমন এক নৈরাজ্যময় ঘটনা, যাহার উপর যথার্থ নিয়ন্ত্রণ না থাকিলে গুরুতর বিপদ ঘটা সম্ভব। আধুনিক রাষ্ট্র বিষয়েও তাঁহার অনুরূপ সতর্কবাণী ছিল। সেই বার্তা মনে করিয়া বলা যায়, রাষ্ট্রের চক্ষু যেমন নাগরিক-জীবনে সর্বত্রবিহারী, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের উপরেও তেমন নাগরিক-সমাজের সদাসতর্ক দৃষ্টিক্ষেপণ অত্যন্ত জরুরি। এই দৃষ্টিটি রাখিবার জন্যই তাঁহারা জন-প্রতিনিধিদের সংসদে পাঠাইয়া থাকেন!
য ত্ কি ঞ্চি ত্
৬৬এ-কে অর্ধচন্দ্র দেওয়া হয়েছে, ৬৬ জন এ-ক্লাস গুন্ডাকে পোষার ও লেলিয়ে দেওয়ার এক্তিয়ারকে তো আর রদ্দা কষানো হয়নি! কোর্টের ভেতরে সূক্ষ্ম বাক্যের ব্যাখ্যা নিয়ে তক্কাতক্কি চলুক না, কোর্ট থেকে সামান্য দূরে স্থূল লাঠি নিয়ে চিত্রসাংবাদিককে ধমাধম পিটিয়ে দিলে তো তর্কাতীত দাপট! আসল প্রশ্ন: থিয়োরির ওপর জোর দেবে, না প্র্যাকটিকাল? ‘বাক্স্বাধীনতা’র অ্যাবস্ট্রাক্ট ধ্বজার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা থাক, আর বক্তার টুঁটি জোর টিপে বোঝানো হোক, কত বাক্-এ কত ফাঁক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy