অরবিন্দ কেজরীবাল কি শপথ করিয়াছেন যে তিনি নিজেকে ব্যর্থ প্রশাসক প্রমাণ করিয়াই ছাড়িবেন? দিল্লিতে সরকার গড়িয়া প্রথম দফায় তিনি ঊনপঞ্চাশ দিনে ইস্তফা দিয়াছিলেন, সেই সংক্ষিপ্ত পর্বটুকুও ঊনপঞ্চাশ বায়ুর উপদ্রবে উত্তাল ছিল। তাহার পরেও দিল্লির ভোটদাতারা তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন নাই, বরং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ফিরাইয়া আনিয়াছেন। এই মাপের গরিষ্ঠতা জননেতাকে বড় সুযোগ দেয়। প্রশাসনের সুযোগ। প্রশাসক হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। কিন্তু গরিষ্ঠতা বিপজ্জনকও। সেই বিপদের নাম অহমিকা। কার্যত বিরোধীশূন্য আইনসভায় অধিষ্ঠিত হইয়া প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী ভাবিতে পারেন, সবার উপরে তিনিই সত্য, তিনি যাহা চাহিবেন তাহাই হইবে। সরকারি আধিকারিক নিয়োগের প্রশ্নে দিল্লির উপরাজ্যপাল নজীব জঙ্গের সহিত তাঁহার যে লড়াই বাধিয়াছে, তাহার পিছনে এই অহমিকার ভূমিকা সুস্পষ্ট। এই বিবাদ কোনও বড় নীতি বা আদর্শ সংক্রান্ত নয়, নিতান্তই প্রশাসন পরিচালনার অভ্যন্তরীণ পদ্ধতি লইয়া দড়ি টানাটানি চলিতেছে। তাহাতে আমলাদের মানসিক সুস্থিতি এবং কাজের পরিবেশ নষ্ট হইতেছে, মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সহকর্মীদেরও বিস্তর সময় নষ্ট হইতেছে। কিন্তু, যথা পূর্বং তথা পরম্, কাজের কাজ অপেক্ষা এই ধরনের বচসার প্রতিই যেন অরবিন্দ কেজরীবালের বিশেষ প্রীতি।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তাঁহার সরকারের সচিব নিয়োগের বিষয়ে তাঁহার মতই শেষ কথা। এই ধারণা স্বতঃসিদ্ধ নয়। অন্যান্য রাজ্য হইতে দিল্লি স্বতন্ত্র, তাহার প্রশাসনের উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বিলক্ষণ, এমনকী দিল্লির পুলিশও মুখ্যমন্ত্রীর অধীন নহে, তাহার রশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে। এই ব্যবস্থা লইয়া প্রশ্ন থাকিতে পারে, রশিটিকে ব্যবহার করিয়া নরেন্দ্র মোদী কেজরীবালকে শায়েস্তা করিতে তত্পর— এই অভিযোগও উড়াইয়া দিবার কোনও কারণ নাই, রাজনীতিতে এ-রকম তো কতই হয়। কিন্তু বিরোধ থাকিলেই তাহার পিছনে ষড়যন্ত্র আছে, এমন অনুমান একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর শোভা পায় না। এবং দিল্লি শাসনের আইন ও বিধিব্যবস্থার পরিবর্তন যদি তাঁহার কাঙ্ক্ষিত হয়, তবে সে জন্য জনমত গড়িয়া তুলিতে পারেন, কেন্দ্রের সহিত আলোচনা করিতে পারেন, গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনও গড়িতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ আইন পরিবর্তিত না হইতেছে, ততক্ষণ সীমিত ক্ষমতার গণ্ডিতেই কাজ করিতে হইবে। আইন বা সংবিধানের ব্যাখ্যা লইয়াও তাঁহার ভিন্নমত থাকিতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রে মতানৈক্য নিরসনের উপায় আলাপ-আলোচনা, কর্মনাশা বচসা নহে।
গণতান্ত্রিক মানসিকতা ভোটবাক্সে থাকে না, থাকে চিন্তার অনুশীলনে। অরবিন্দ কেজরীবালের সেই অনুশীলনে ঘাটতি আছে, তাহা অতি স্পষ্ট। তাঁহার দলের মধ্যে যে ধরনের অশান্তি দেখা গিয়াছে, তাহা যে ভাবে দলত্যাগ বা বহিষ্কারের অশোভন প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হইয়াছে, সেই বৃত্তান্তগুলি এই ঘাটতির সূচক। সাজিয়া ইলমি, যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণদের কাহার কতটা দোষ বা অসহিষ্ণুতা ছিল, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু দলের সর্বাধিনায়ক হিসাবে কেজরীবাল যে ভাবে এই সহকর্মীদের সমালোচনা বা বিরোধিতার মোকাবিলা করিয়াছেন, তাহাকে গণতান্ত্রিক বলিবার কোনও উপায় নাই। ভিন্নমতের সহিত, ভিন্নমতকে সঙ্গে লইয়া কাজ করিবার অভ্যাস যদি তাঁহার স্বভাবে থাকে, তবে সেই অভ্যাস তিনি পরম যত্নে লুকাইয়া রাখিয়াছেন। ইহা ভারতীয় রাজনীতিতে নিতান্ত অপরিচিত নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ এই একেশ্বরবাদের নমুনা বিস্তর দেখিয়া চলিয়াছে। কলিকাতা গত কাল যে ব্যাধিতে ভুগিয়াছে, দিল্লি আজ তাহাতে আক্রান্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy